প্রতিটি দেশ সম্ভাব্য বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেতে সামরিক বাহিনী গঠন করে। দেশের ভিতরে বা বাইরে থাকা শত্রুরা যাতে ক্ষতি করতে না পারে তার জন্য কর দাতাদের টাকায় এই সমস্ত বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে অন্য কাজ হয়। আর তাই সংশ্লিষ্ট দেশের সামরিক বাহিনী সেখানকার সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে থেকে কাজ করে। দেশের নাগরিকদের যে কোনও প্রয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়ে । তবে এই ব্যবস্থার অন্যথা হয় না এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই ।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর এক বিশেষ চরিত্র আছে। সে এক এমন দেশ যার সামরিক বাহিনীর প্রধানরা ক্ষমতা আর অর্থের বলে ক্রমশ বলিয়ান হতে থাকেন আর দেশ চলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ধারের টাকায় এবং মিত্র দেশের অনুদানে। চিনের জন্য বিষয়টা আবার অন্যরকম। চিনে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা নেতারা দেশের জনগণকে ভয় পান । কারণ, তাঁরা নাগরিকদের সাধারণ অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছেন। স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার কেড়ে নিয়েছেন । আর তাই তাঁদের এমন এক বাহিনী চাই যার অবস্থান হবে দেশের জনতা এবং রাজনৈতিক শ্রেণির মাঝামাঝি। রাজনৈতিক শ্রেণির প্রভুত্ব রক্ষাই বাহিনীর অন্যতম বড় কাজ । ঠিক এই ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায় রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এবং তাঁর নেতৃত্বে থাকা চিনের কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপে।

পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) কাজ করে কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের অধীনে। এই কমিশনের প্রধান রাষ্ট্রপতি নিজে। এছাড়া চিনের প্রধান আধাসামরিক বাহিনী পিপিলস আর্মড পুলিশও এই কমিশনের অধিনে। বিশ্বের মধ্যে চিন-ই একমাত্র দেশ যার সশস্ত্র বাহিনী সরকারিভাবে শাসক দলের সশস্ত্র শাখা হিসেবে চিহ্নিত । 2014 সালের চিনের প্রবীণ সামরিক কর্তারা সমর-ব্যবস্থায় শি জিনপিংয়ের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের আনুগত্য প্রমাণ দিয়েছিলেন।
2024 সালের জুন মাসে সামরিক কমিশনের রাজনৈতিক কর্তব্য ঠিক করা সংক্রান্ত বৈঠকে শি জিনিপিংকে বলতে শোনা গিয়েছিল, "অস্ত্র তাঁদের হাতেই থাকা উচিত যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি অনুগত এবং যাঁদের উপর পার্টি আস্থা রাখতে পারে।" এখানে উল্লেখ করা দরকার, এই আনুগত্যের পাঠ চিনের সামরিক বাহিনীর সমস্ত সদস্যকে কর্মজীবনের প্রথম দিন থেকেই দেওয়া হয়ে থাকে। বোঝানো হয়, তাঁদের আনুগত্য প্রথমে দেশের শাসক দল এবং রাষ্ট্রপতির প্রতি। দেশের নাগরিকদের কথা পরে ভাবলেও চলবে।

পিএলএ-র মধ্যেও নানা ধরনের সমস্যা চলছে। শীর্ষ পদে থাকা একাধিক আধিকারিক দুর্নীতির দায়ে অপসারিত হচ্ছেন। এমন গুজবও শোনা যায় এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে পিএলএ-র মধ্যে থাকা ক্ষমতার লড়াইয়ের যোগাযোগ আছে। 2012 সাল থেকে এ পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন শীর্ষ পদে থাকা 160 জন কর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে । চিনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রয়েছেন এই তালিকায়। তাঁদের বদলে যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন তাঁরাও জানেন যে কোনও দিন অপসারিত হতে পারেন। আর তাই শীর্ষ পদে থাকা সামরিক কর্তাদের অনেকে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি অনুগত থাকাকেই শ্রেয় বলে মনে করেন।
একজন সৈনিক লড়াইয়ের শক্তি পান দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে। সেই ভালোবাসাই কর্তব্যের প্রতি অবিচল করে রাখে তাঁকে। তাছাড়া দেশ যে সম্মান দেয় তা-ও লড়াইয়ের শক্তি দেয় সেনা বাহিনীর সদস্যদের। ভারতের সামরিক বাহিনীর প্রতিটি সদস্য দেশের প্রতি দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকেন। কারণ, তাঁরা জানেন কোনও কারণে যুদ্ধ ক্ষেত্রে শহিদ হতে হলে পরিবারের ভার নেবে দেশ। পাশাপাশি শুধুই সুরক্ষা দেওয়া বাহিনীর কাজ নয়। সঙ্কটে দেশবাসীকে সাহায্য করাও তাদের কাজ। বিপর্যয়ের সময় তারাই প্রধান ভরসা। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবনতি হলেও তাদেরই শরণ নিতে হয় দেশকে। আর তাই সেনা বাহিনীর প্রতি ভারতীয়রা সর্বদা শ্রদ্ধাশীল।
চিনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা। কমিউনিস্ট পার্টি বাহিনীর প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে। বাহিনীর 66 শতাংশের মূল কাজ ঘরোয়া অসন্তোষ সামাল দেওয়া। নাগরিকদের উপর নির্মম কায়দায় সরকারি নীতি চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যম পিএলএ। এই প্রক্রিয়া কমিউনিস্ট পার্টির ভাবমূর্তির কতটা ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়ে ভাবিত নয় চিনের শাসক শিবির।
1989 সালে তিয়েনমেন স্কোয়ারে প্রতিবাদীদের মোকাবিলা করতে সামরিক বাহিনীর সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে সামিল হওয়া হাজারো তরুণ-তরুণীর প্রাণ গিয়েছিল বাহিনীর গুলিতে। হংকংয়ে গণতন্ত্রের দাবিতে সরব হওয়া মানুষের কণ্ঠরোধ করার কাজও করেছিল সেনা। জিনপিংয়ের অতি-কঠোর কোভিড-নীতি প্রণয়নের ভারও ছিল সেনার উপর। মানুষকে খাবার বা জল না দিয়ে আটকে রেখে করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্রতী হয়েছিলেন জিনপিং। সেই কাজে তাঁকে সেনা সাহায্য করেছে। নির্দেশ ছিল, কেউ প্রতিবাদগ করলেই গুলি চালাতে হবে। গুলি চলেছে। এটা নৈরাজ্য কিন্তু চিনের দিক থেকে সাধারণ ঘটনা।

ভারতীয় সেনা কোনও যুদ্ধে কখনও পিছিয়ে আসেনি। শেষ পর্যন্ত লড়াই লড়েছে। 1962 সালের যুদ্ধের সময়ও সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও হার মেনে নেয়নি ভারতীয় সেনা বাহিনী। প্রতিটি পোস্টে শেষ পর্যন্ত লড়াই চলেছে। শত্রুর হাত থেকে কার্গিল ছিনিয়ে নেওয়া-ও সহজ ছিল না। সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা পরিস্থিতিতেও জয় এসেছিল।
পিএলএ-র ব্যাপারে এ কথা বলার কোনও জায়গা নেই। 1962 সালের যুদ্ধে তারা জিতেছিল সংখ্যার বলে। ওই যুদ্ধে তাদের কতজন সেনা জওয়ানের প্রাণ গিয়েছিল তা আজও জানায়নি চিন। ভিয়েতনামে চিনের পরাজয় হয়েছে। 1967 সালে নাথুলা এবং চোলা পাসে ভারতীয় সেনা তাদের আটকেছে। 1986 সালে অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াংয়ের সমুদ্রদুর্গ চু উপত্যকায় ভারতীয় বাহিনীর কাছে পরাস্ত হয়েছে চিন। ভারতীয় সামরিক বাহিনী জবাব দিলেই পালিয়েছে চিনের সেনা বাহিনী।
যুদ্ধে শহিদদের দেহ দেখে ভারতীয় নাগরিকরা চোখের জল ফেলেন। কার্গিলে শহিদদের শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শহরের শহর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল এমনও দেখা গিয়েছে। কার্গিলের মতো গালওয়ান সীমান্তে শহিদদেরও একইভাবে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল দেশ। কিন্তু চিনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বেশ অন্যরকম। যুদ্ধে কোনও জওয়ান নিহত হয়েছেন এ কথার কী প্রতিক্রিয়া দেশে হবে তা বুঝতে পারে না শাসক। সেই ভয় থেকেই গালওয়ানের সংঘর্ষে কতজনের প্রাণ গিয়েছে তা এখনও জানায়নি বেজিং । মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিজেদের ভাবমূর্তি ধরে রাখার চেষ্টা করে । অন্যদিকে, গণতন্ত্রের জন্য সাওয়াল করা ব্লগারদের গ্রেফতার করে চলেছে। কমিউনিস্ট চিনের এটাই চরিত্র- তারা নিজেদের নাগরিকদের থেকে সত্য গোপন করে আবার পিএলএ-র বিপর্যয়ে জনমত বিপক্ষে যাওয়ার ভয় পায়।

ভারতীয় সেনা বাহিনীর অংশ হতে চায় বহু মানুষ। পিএলএ-র অংশ হওয়া নিয়ে তেমন আগ্রহ চোখে পড়ে না। বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে পাওয়া তথ্য় বলছে শিক্ষিত যুবকদের অনেকেই সেনার অংশ হতে চান না। কোনও কারণে যোগ দিলেও প্রথম সুযোগেই অন্যত্র চলে যান । এতকিছুর পরেও যাঁরা থেকে যান তাঁদেরও লক্ষ্য থাকে আগামিদিনে ভালো কোনও সুযোগ মেলে কি না সেই সন্ধানে থাকা। নাম-নুন-নিশান এরকম কোনও ধারনা চিনের সামরিক বাহিনীতে নেই। মানে নিজের নামের জন্য কাজ করা বা দেশের প্রতি আনুগত্য থাকার মতো বিষয় সেখানে কাজ করে না। কারণ, বাহিনীর প্রধানরা শুধু কমিউনিস্ট পার্টি বা রাষ্ট্রপতির কাছে ভালো থাকতে চান।
আর ঠিক এই কারণেই চিন সরাসরি যুদ্ধে যেতে চায় না। প্রতিপক্ষকে অন্য কোনও কায়দায় কাবু করতে চায়। তারা জানে ভারতীয় সেনা শক্তিশালী। কারণ তারা রাজনৈতিক নয়, জাতীয় বাহিনী। অন্যদিকে, পিএলএ-র কাজ কমিউনিস্ট পার্টি এবং রাষ্ট্রপতির স্বার্থ রক্ষা করা। এমন বাহিনী কখনও যুদ্ধে লড়ে জেতার জন্য অনুপ্রাণিত হতে পারে না। আর তাই চিনের সামরিক কমিশনকে যুদ্ধ বা সম্মুখ সমর ছেড়ে অন্য পথে সংঘাতে সমাধান করতে হবে।