রাশিয়া-ইউক্রেনে যুদ্ধ বহু মানুষের মৃত্যর সাক্ষী। রাশিয়ার প্রায় 95 হাজার সেনার প্রাণ গিয়েছে। ইউক্রেনের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা 43 হাজার। এর পাশাপাশি ঘর ছাড়া মানুষের সংখ্যাও কয়েক লাখ। 2022 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া আক্রমণ শুরু করে । আর এখন ইউক্রনের প্রায় 20 শতাংশ এলাকা রাশিয়ার দখলে। তাছাড়া অগস্ট মাসের কুর্স্ক হামলায় যে পরিমাণ জমি ইউক্রেন নিজেদের দখলে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল তারও 70 শতাংশের নিয়ন্ত্রণ আবারও নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে রাশিয়া। এমনই আবহে ওয়াশিংটনের প্রস্তাব 30 দিনের জন্য যুদ্ধ বন্ধ রাখা হোক। সেই প্রস্তাবে 'নীতিগতভাবে' রাজি হয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। তবে তার জন্য অনেক শর্ত আরোপ করেছেন। প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। অন্যদিকে ইউক্রেন চায় যুদ্ধ এখনই বন্ধ হোক।
প্রতিবন্ধকতা
একমাসের এই যুদ্ধবিরতি খুব সহজ নয়। বরং বেশ জটিল। বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও হতে হবে সংশ্লিষ্ট সকলকে। পুতিন বেশ কিছু শর্ত আরোপ করেছেন। তার মধ্য়ে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য না করার কথা আছে। এই প্রসঙ্গে কোনও আলোচনাও হবে না। আগাম এই আশ্বাস নিয়েই তিনি কথা শুরু করতে চান। তাছাড়া ইউক্রেনে নির্বাচনও চেয়েছেন তিনি। তাঁর অভিপ্রায় প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি ক্ষমতার বাইরে যাবেন। ইউক্রেনের বহু এলাকা রাশিয়ার দখলে গিয়েছে। সেগুলি যে এখন থেকে রাশিয়ার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত হবে তার সরকারি স্বীকৃতি চেয়েছেন পুতিন। সেখান থেকে ইউক্রেনের বাহিনী সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নিতে হবে বলেও মস্কোর দাবি। এছাড়া সামরিক অভিযানের জন্য ইউক্রেনকে কোনও রকম সাহায্য কেউ করবে না-সেই নিশ্চয়তাও চান তিনি। পাশাপাশি ইউক্রেনে থাকা যে সমস্ত নাগরিক রাশিয়ান ভাষায় কথা বলেন তাঁদেরও নিরাপত্তা চেয়েছেন পুতিন।

মার্কিন প্রশাসনের তথ্য ঘেঁটে সংবাদসংস্থা রয়টার্সের দাবি, রাশিয়া চায় ইউরোপের যে সমস্ত জায়গা তাদের দেশের খুব কাছাকাছি সেখানে আমেরিকার ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের মিসাইলের ব্যবহার বন্ধ হোক। একইসঙ্গে মার্কিন বা ন্য়াটোর সামরিক মহড়া নিয়েও কয়েকটি বক্তব্য আছে রাশিয়ার। ককাসাস পর্বত থেকে মধ্য এশিয়ায় এই ধরনের মহড়া চান না পুতিনরা। চাহিদার শেখ এখানেই নয়। একসময় কমিউনিস্টদের দাপট ছিল পোল্যান্ড থেকে শুরু করে রোমানিয়ার মতো দেশে। সেখানেও ন্যাটোর উপস্থিতি নাপসন্দ রাশিয়ার।
রাশিয়ার কুর্স্ক অঞ্চলে থাকা ইউক্রনের সামরিক বাহিনী শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের দেশে ফিরে যান এমনটা পুতিনের অভিপ্রায় নয়। তবে মার্চ মাসের 14 তারিখ টোলিফোনিক আলোচনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প পুতিনতকে ওই সমস্ত সেনা জওয়ানদের প্রাণ রক্ষার অনুরোধ জানিয়েছেন। এরপর পুতিন কুর্স্ক অঞ্চলে থাকা ইউক্রেনের বাহিনীকে আত্মসমপর্ণের চৃড়ান্ত নির্দেশ দিয়েছেন । তা না হলে তাঁদের জীবনের নিশ্চয়তা দেবে না রাশিয়া। সমস্ত দিক থেকেই স্পষ্ট, যুদ্ধ বিরতির আগে তারা নিজদের সামরিক অবস্থান শক্তপোক্ত করতে চায় । তবে জেলেনস্কি গত শনিবার জানিয়েছেন, কুর্স্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। অন্য কোনও বাহিনী তাদের গতিপথ অবরুদ্ধও করেনি।

রাশিয়া-ইউক্রেনের সমঝোতার ব্যাপারে সবচেয়ে কঠিন বিষয় হল সীমানা সংক্রান্ত সমস্যা । এই প্রসঙ্গে লাতভিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রিস স্পুড সিএনএন ইন্টারন্যাশনালকে বলেছেন, "রাশিয়া সালামি কৌশল ব্যবহার করতে চাইছে। এই কৌশলের ফলে তারা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক লক্ষ্য প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে।" সালামি কৌশল বিশ্ব রাজনীতিতে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। এর মাধ্যমে কোনও একটি দেশ ধীরে ধীরে নিজেদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়। ধাপে ধাপে জয় আসে । আর সবথেকে বড় কথা, এই কৌশল অনুসারে সমস্ত পদক্ষেপই চুপিসারে নেওয়া হয়। রাশিয়া ক্রিমিয়ার দখল নিয়েছে। তাছাড়া ডনটেস্ক, লুহানস্ক, ঝাপরজিয়ার মতো এলাকাকেও নিজেদের হিসেবে দাবি করেছে । চেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। ইউক্রেন কখনও এমন দাবিকে মান্যতা দেয়নি।
2023 সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গর্ভ মীরজায়ান রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ করা নিয়ে কয়েকটি দাবি করেছিলেন । তাঁর মনে হয়েছিল, এই সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে একটা সময় আসবে যখন দু'পক্ষের কাছেই আরও কোনও বিকল্প থাকবে না। তারা বাধ্য হবে কোরিয়া যুদ্ধের পরিণামের মতো পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে যুদ্ধ শেষ করতে হবে। এখন ট্রাম্প আর পুতিনের আলোচনাতেও বিষয়টি সেদিকেই যাচ্ছে। এই দু'জনের আলোচনায় কোনও ফল হলে কোরিয়া যুদ্ধে যা হয়েছিল এখানেও তাই হবে। রাশিয়ান ভাষায় কথা বলে এমন সব প্রদেশ চলে যাবে রাশিয়ার দিকেই।
যুদ্ধ আরও দীর্ঘদিন চললে কী হবে ?
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব খারিজ হয়ে গেলে আরও দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চলতে থাকবে। সেক্ষেত্রে ইউক্রেন আমেরিকার পাশাপাশি ইংল্য়ান্ড এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকেও সাহায্য পাবে। ইউক্রেনকে আবারও সামরিক সাহায্য দিতে শুরু করেছে আমেরিকা। রাশিয়ার বাহিনী সম্পর্কে গোপন খবরাখবর দেওয়াও আবার শুরু করেছে তারা। পাশাপাশি রাশিয়ার তেল থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ক এবং গ্যাসের ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যুদ্ধ করতে রাশিয়া ইলেকট্রনিক জ্যামিং টেকনিকের সাহায্য নেয় তার পাল্টা জিএলএসডিবি বোমা ব্যবহার করছে ইউক্রেন। এই বোমা তাদের আমেরিকা দিয়েছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লায়েন 800 বিলিয়ন ইউরোর তহবিল তৈরির ঘোষণা করেছেন । সদস্য দেশগুলির থেকে এই পরিমাণ অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা হচ্ছে । সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী হওয়াই এই তহবিলের মূল লক্ষ্য। জেলেনস্কি লন্ডনে গিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে লন্ডনে দেখা করেছেন। কমপক্ষে 20টি দেশ ইউক্রেনকে 'মন থেকে' সাহায্য করার ব্যাপারে একমত হয়েছে। এই প্রস্তাব দিয়েছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার। 15 মার্চ বিশ্বের 29টি দেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে এই প্রস্তাব দেওয়ার পাশাপাশি তিনি জানান, লন্ডনে এই সমস্ত দেশের সামরিক বাহিনীর প্রধানরা বৈঠক করবেন। ঠিক করবেন কীভাবে ইউক্রেনের নিরাপত্তাকে জোরদার করা যায়।
ভারতের উপর কী প্রভাব ?
ভারত চিরকাল রাশিয়া ও ইউক্রেনের বন্ধু। 2024 সালের জুলাই মাসে দু'দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি । পুতিন এবং জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করে মোদি দাবি করেছেন, ভারত শান্তি চায়। আলোচনা চায়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে হোয়াইট হাউজে আয়োজিত ডায়লগ অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন "ভারতের অবস্থান নিয়ে অনেকের মধ্যে ভুল ধারনা আছে। আমরা বলে দিতে চাই, আমরা নিরপেক্ষ নই । শান্তির পক্ষে।",

এর আগে পুতিনের সঙ্গে বৈঠকেও মোদি জানান, এটা যুদ্ধের সময় নয়। এরপর পুতিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে চর্চার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানান। মস্কো এবং কিভের মধ্যে সমঝোতা রক্ষা করে চলেছে ভারত। আর তার ফলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দুই দেশের প্রধানেরই যোগাযোগ রয়েছে। শান্তির বাহক হিসেবে তাঁকে দু'পক্ষই সমর্থন করতে পারে। তাছাড়া শান্তি স্থাপনের জন্য একটি কার্যকরী ভূমিকাও তিনি নিতে পারেন। একটি ভালো সমীকরণ ছাড়া এই পরিস্থিতির সমাধান হবে না। সেই সমীকরণ বা ফর্মুলা খুঁজে বের করতে বড় ভূমিকা নিতে পারেন মোদি । সেক্ষেত্রে আমেরিকা এবং ইউরোপের উদ্বেগের জায়গা গুলিও মাথায় রাখবেন মোদি।
যুদ্ধবিরতি ভারতকে আমদানির প্রশ্নে সাহায্য করতে পারে। পরিস্থিতি শান্ত হলে সূর্যমুখী তেল থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেশিন, লোহা, স্টিলের সামগ্রী রয়েলার এবং নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টার ভারতে নিয়ে আসা সহজ হবে। তাতে দেশের ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের নানা উপকার হবে। অন্যদিকে রাশিয়াও ভারতকে প্রতিরক্ষা থেকে শুরু করে প্রযুক্তির প্রশ্নে সাহায্য করতে পারে। যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর ইউক্রেনকে নতুন করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও ভূমিকা নিতে পারে ভারত । এখান থেকেই বোঝা যায় ভারতের ভূমিকা সবমিলিয়ে বিরাট।
পোল্যান্ডের ডেপুটি বিদেশ মন্ত্রী ভ্লাদিস টিওফিল একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, মোদি নিজের প্রভাব খাটিয়ে পুতিনকে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার থেকে বিরত রেখেছিলেন । 2023 সালে সিআইএ-র তৎকালীন প্রধান বিল বার্নসও একই দাবি করেছিলেন ।
এরপর কী ?
রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে চলছে। কিন্তু এর সমাধান সূত্র খুঁজে বের করা আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। তার একটা বড় কারণ ট্রাম্প। তিনি নিজে বিশ্বের কার্য পদ্ধতি বদলাতে চান। ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে ইউরোপ দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। তিনি তাঁর নীতি পুরোভাগে রাখতে চাইছেন রাশিয়াকে । যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শেষ করে চট্রাম্প চান, ইউরোপ আবার চিনকে মোকাবিলার প্রশ্নে তাঁর পাশে এসে দাঁড়াক। কিন্তু রাশিয়া যে মনোভাব নিয়ে চলেছে তাতে সমস্যার সমাধান খুব তাড়াতাড়ি হবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং গুপ্তচর সংস্থা মনে করে পুতিন এখনই শান্তি প্রক্রিয়া শেষ করবেন না। টেনে নিয়ে যাবেন 2026 সাল পর্যন্ত। ইউক্রেন এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশ এমনও মনে করে পুতিন যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলেও 2014 সালের মতো চুক্তি ভঙ্গ করতে পারেন। সেবার বুদাপেস্ট চুক্তি লঙ্ঘন করেছিল রাশিয়া। রাশিয়া, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড ইউক্রেনকে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করতে বলেছিল নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে ।
সবমিলিয়ে যুদ্ধবিরতি দীর্ঘ এবং জটিল কাজ। পাশাপাশি রাশিয়া বা ইউক্রেন যুদ্ধবিরতির প্রতি একশো শতাংশ শ্রদ্ধাশীল থাকবে সেটাও মেনে নেওয়ার কারণ নেই । হতে পারে এই যুদ্ধবিরতিকে কাজে লাগিয়ে তারা আবার শক্তি বৃদ্ধির কাজ শুরু করল । আর তাই যুদ্ধ বিরতির জন্য সবদিক থেকে সুরক্ষিত এমন একটি পরিকল্পনা করতে হবে । যুদ্ধবিরতির এই সুফল এমন হওয়া উচিত যা দীর্ঘদিন থাকবে ।