নয়াদিল্লি, 19 মার্চ: ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোবগের ভারত সফরের এক সপ্তাহ কাটার আগেই এবং আগামী মাসে শুরু হওয়া লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই সপ্তাহে প্রতিবেশী ওই দেশে দু’দিনের সফরে যাচ্ছেন । প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভুটানে মোদির এটা তৃতীয় সফর হতে চলেছে । এর আগে 2014 ও 2019 সালে তিনি ওই দেশ সফর করেছিলেন ।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয়বারের মতো তাঁর দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম সরকারি বিদেশ সফরে ভারতে এসেছিলেন টোবগে । সেই সফরের সময় গত 14 মার্চ টোবগে নয়াদিল্লিতে মোদির সঙ্গে একটি বৈঠক করেন৷ তখনই তিনি মোদিকে ভুটান সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানান ।
ওই বৈঠকের পরে ভারত ও ভুটানের পক্ষ থেকে একটি যৌথ বিবৃতি জারি করা হয় ৷ সেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদি জানান যে ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগেল ওয়াংচুকের দৃষ্টিভঙ্গি এবং জনগণ ও ভুটানের রয়্যাল গর্ভনমেন্টের অগ্রাধিকার ওই দেশকে উচ্চআয়ের পথে প্রতিষ্ঠিত করবে ৷ আর এর সঙ্গে সাজুয্য রেখে ভুটানের সঙ্গে অংশীদারিত্ব করতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ।
বিবৃতিতে বলা হয়, "প্রধানমন্ত্রী মোদি ভুটানের 13তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সাহায্য বাড়ানোর জন্য ভারতের প্রতিশ্রুতি আবারও উল্লেখ করছে ৷ একই সঙ্গে বিবেচনায় রাখা হয়েছে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি সহায়ক কর্মসূচির বাড়ানোর অনুরোধও ৷ ভারতের তরফে উন্নয়নে সহায়তার মধ্যে পরিকাঠামোর উন্নয়ন, রাস্তা, রেল, বিমান ও ডিজিটাল সংযোগ এবং কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, দক্ষতা ও সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের মতো সেক্টরে ব্যাপক আকারে সংযোগ স্থাপন করা হবে ৷’’
2024-25 সালের অন্তর্বর্তী বাজেটে বিদেশ মন্ত্রককে 22 হাজার 154 কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে । নয়াদিল্লির নেবারহুড ফার্স্ট নীতির অধীনে ভুটানকে 2 হাজার 68 কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে ৷ যা এই প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ ৷ 2023-24 সালে এই বরাদ্দের পরিমাণ ছিল 2400 কোটি টাকা ৷
টোবগে তাঁর দেশকে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বের করে আনতে চান ৷ তাই তিনি ভারতের সমর্থনে 15 বিলিয়ন টাকার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে ৷ গত 29 ফেব্রুয়ারি থিম্পুতে একটি মিট-দ্য-প্রেস সেশনে এই ঘোষণা করেন তিনি ৷ সেই সময় টোবগে জানান, একটি বিস্তৃত কৌশল তৈরি করতে ও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন তদারকি করার জন্য একটি বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে ।
হিমালয় অঞ্চলের রাজত্বে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের আগে টোবগের পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) 'ভুটানের সঙ্গে চুক্তি' শিরোনাম দিয়ে ইস্তেহার প্রকাশ করে ৷ সেখানে ভুটানকে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় । সেখানে বলা হয়, "আমাদের দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে ৷ গত পাঁচ বছরে গড়ে মাত্র 1.7 শতাংশ বৃদ্ধির হার-সহ, আমাদের অর্থনীতি আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে । আমাদের বৃদ্ধির প্রধান চালক বেসরকারি ক্ষেত্র থেমে গিয়েছে ৷ অনেক ব্যবসা হয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে বা কম ক্ষমতায় কাজ করছে । যুবদের বেকারত্ব রেকর্ড সর্বোচ্চ 28.6 শতাংশে পৌঁছেছে ।”
তিনি জানান যে ভুটানের সরকারি ঋণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে ৷ বিশেষ করে নন-হাইড্রো ঋণ 108 বিলিয়ন টাকা । বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এত নিচে নেমেছে যে সাংবিধানিক প্রয়োজনীয়তা লঙ্ঘনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে । রাজস্ব ঘাটতি বেড়েছে৷ জাতীয় রাজস্ব কমেছে ।
টোবগে বলেন, "2022 সালে মোট 80 হাজার 614 ভুটানি মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছেন ৷ অর্থাৎ প্রায় আটজনের মধ্যে একজন ভুটানি তাঁদের খাদ্য এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটাতে সংগ্রাম করছেন । আমাদের গ্রামাঞ্চলে উন্নয়ন প্রায় থমকে গিয়েছে । বিষয়টি হয়েছে যখন সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পেশাদার ও দক্ষ ব্যক্তি-সহ অভূতপূর্ব সংখ্যক ভুটানি বিদেশে উন্নত অর্থনৈতিক সুযোগের সন্ধানে চলে গিয়েছে ।”
তিনি জানান, এর ফলে ভুটানের সরকারি পরিষেবার উপর চাপ পড়ে ৷ বিশেষ করে দেশের হাসপাতাল, স্কুল ও সরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করে । এই অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং ভুটানিদের ব্যাপক দেশ ছাড়া এমন এক সময়ে ঘটছে যখন ভুটান প্রজনন হারও ব্যাপকভাবে কমতে শুরু করে ৷ যা বর্তমানে 1.8 শতাংশে দাঁড়িয়েছে ৷ প্রতিস্থাপন হার 2.1-এর নিচে ।
টোবগে আরও বলেন, "যদি আমরা এই প্রবণতাগুলিকে থামাতে না পারি, তাহলে আমাদের জাতির কার্যক্ষমতাই শেষ হওয়ার মুখে পড়বে ৷ যদি আমরা অবিলম্বে সংশোধন না করি, তাহলে আমাদের প্রিয় জাতির অস্তিত্ব এবং সার্বভৌমত্ব আশঙ্কার মুখে পড়বে ।" তাই অর্থনীতির পুনর্গঠন ও পুনরুজ্জীবিত করতে এবং ভুটানকে একটি উন্নত দেশে রূপান্তর করতে পিডিপি কিছু মূল অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নির্বাচনী ইস্তেহারে ।
ভুটানের 13তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকে সমর্থন করায় ভারতের প্রতিশ্রুতির জন্য, এটি উল্লেখ করার মতো যে নয়াদিল্লি ওই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে 1960-এর দশকের গোড়ার দিকে যখন তার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চালু করেছিল, তখন থেকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে আসছে । ভারত ভুটানের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী হিসাবে অবিরত রয়েছে ।
12তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ভারতের দেওয়া 4500 কোটি টাকা বাইরে থেকে ভুটানের পাওয়া অনুদানের 73 শতাংশ । ভারত সরকারের সহায়তার প্রধান ক্ষেত্রগুলির মধ্যে রয়েছে কৃষি ও সেচ উন্নয়ন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, শিল্প উন্নয়ন, সড়ক পরিবহণ, জ্বালানি, অসামরিক বিমান চলাচল, নগরোন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, সক্ষমতা বৃদ্ধি, বৃত্তি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি ।
মোদি ও টোবগের বৈঠকের পর জারি হওয়া যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, "প্রধানমন্ত্রী মোদি গেলফু মাইন্ডফুলনেস সিটি নিয়ে রাজার দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করেছেন, যা ভুটান ও এই অঞ্চলকে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাবে ৷ আর ভারত ও ভুটানের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং বিনিয়োগের সম্পর্ককে আরও জোরদার করবে ৷"
গেলফু স্পেশাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিজিয়ন (এসএআর), গেলফু মাইন্ডফুলনেস সিটি নামে পরিচিত ৷ গত বছরের ডিসেম্বরে ওই দেশের জাতীয় দিবস উপলক্ষে ভুটানের রাজা এই নিয়ে ঘোষণা করেন ৷ এটা এই অঞ্চলের জন্য একটি গেম-চেঞ্জার হবে বলে আশা করা হচ্ছে ৷ কারণ, এর ফলে সেখানে বিনিয়োগ বাড়বে৷ ভুটানের রাজা গত বছরের নভেম্বরে ভারতে সরকারি সফরের পরপরই এই ঘোষণা করেন । সেই সময় রাজা ওয়াংচুক অসমম ও মহারাষ্ট্রেও তাঁর প্রথম সরকারি সফর করেছিলেন ।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অসমের চিরাং জেলার সীমান্তবর্তী ভুটানের সারপাং জেলায় গেলফু মাইন্ডফুলনেস সিটি তৈরি করা হবে । গেলফু হল ভারত থেকে ভুটানে যাওয়ার তিনটি প্রবেশপথের একটি৷ অন্যটি হল এর পূর্বদিকে থাকা সামদ্রুপ জংখার এবং পশ্চিমে ফুন্টশোলিং । জাতীয় দিবসের ভাষণে ওয়াংচুক জানান যে দক্ষিণ এশিয়া অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সম্মুখীন হচ্ছে ।
রাজা ওয়াংচুক বলেন, "এটি আমাদের বিলিয়ন মানুষ বসবাসকারী অঞ্চলের জন্য বৃদ্ধির সময় এবং বিপুল সুযোগের সময়কাল ৷ গেলেফু বা সামদ্রুপ জংখার থেকে অসম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির মধ্য দিয়ে, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এবং লাওস, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরের সঙ্গে স্থল সংযোগ রয়েছে ৷ এটা একটি অর্থনৈতিক করিডর, যা দক্ষিণ এশিয়াকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করে ।"
হিমালয়ের পাদদেশে তারাইথাং গেওগ থেকে সিংয়ে গেওগ পর্যন্ত প্রায় 1,000 বর্গ কিমি জুড়ে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ৷ গেলফুকে একটি সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক কেন্দ্রে উন্নীত করতে চায় ভুটান৷ যা শুধু ভুটানকে উপকৃত করবে না ৷ বরং বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে অবদান রাখবে । তাঁর ভাষণে ওয়াংচুক জাতিকে অভূতপূর্ব আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির দিকে চালিত করার ক্ষেত্রে বিদেশে বসবাসরত ভুটানি ব্যক্তিদের প্রভাবকে স্বীকৃতি দিয়ে গেলফু এসএআর-এর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন । এই প্রতিশ্রুতি তাঁর বৈশ্বিক প্রবাসীদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য সরকারের নিষ্ঠার ওপর জোর দেয় ।
ওয়াংচুক জানান যে গেলফু এসএআর একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসাবে প্রয়োজনীয় আইন ও নীতি প্রণয়নের জন্য স্বায়ত্তশাসন পাবে । এতে কার্যনির্বাহী স্বায়ত্তশাসন ও আইনগত স্বাধীনতা থাকবে । এই এসএআর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হল একটি প্রাণবন্ত অর্থনৈতিক হাব তৈরি করা ৷ অন্য যেকোনও অর্থনৈতিক হাবে অনুকূল ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি করে বিদেশি বিনিয়োগকে টানা হয় । ভুটানের অর্থনৈতিক কেন্দ্রে এর সঙ্গে আরও অনেক কিছু থাকবে ৷
মোদি ও টোবগের বৈঠকের পর যে যৌথ বিবৃতি জারি করা হয়, সেখানে হাইড্রো-পাওয়ার প্রজেক্টের সম্প্রসারণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে ৷ সরকারি আধিকারিকদের নতুন প্রকল্প তৈরির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতেও বলা হয়েছে ৷ সেখানে পুনাতশংছু-২ হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্টের উল্লেখ করা হয়েছে ৷ ওই প্রকল্প পুরোটাই ভারতের অর্থে হচ্ছে ৷ চলতি বছরের অক্টোবরে তা কাজ করা শুরু করবে বলেও আশা করা হচ্ছে ৷ এখনও পর্যন্ত ভুটানে চারটি হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্ট তৈরি করেছে ভারত ৷
যৌথ বিবৃতিতে ভারত ও ভুটানের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত করার বিষয়ও উল্লেখ করা ছিল ৷ বিশেষ করে 57.5 কিলোমিটার দীর্ঘ অসমের কোকড়াঝাড় থেকে ভুটানের গেলেফু পর্যন্ত 10 বিলিয়ন টাকার প্রকল্প নিয়ে আগেই রাজা ওয়াংচুক ও প্রধানমন্ত্রী মোদির মধ্যে আলোচনা হয়েছে ৷ এই প্রকল্প গেলেফু এসএআর-এ সহায়ক হবে ৷
তবে ভারতে যেহেতু লোকসভা নির্বাচন ঘোষণা হয়ে গিয়েছে, তাই চালু হয়ে গিয়েছে আদর্শ আচরণবিধি, সেই কারণে মোদির এই ভুটান সফরে কোনও চুক্তি সাক্ষরিত হবে না ৷ তারপরও এই সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ৷ কারণ, ভুটানের উপর সীমান্ত সমস্যা নিয়ে চাপ বৃদ্ধি করছে চিন ৷ এটা ভারতের কাছেও চিন্তার বিষয় ৷ কারণ, ভারত বরাবর ভুটানের বন্ধু দেশ ৷ ভুটানের সার্বভৌমত্বরক্ষায় ভারত বরাবর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে ৷
বিশেষ করে 2017 সালে ডোকলামে ভারত ও চিনের মধ্যে যে গোলমাল, তার কারণও ভুটান ৷ সেই সময় সেখানে রাস্তা তৈরি করতে চেয়েছিল চিন ৷ যা ভুটানের অংশের মধ্যে পড়ে৷ ভারত এর তীব্র বিরোধিতা করে ৷ কারণ, ওই রাস্তা হলে ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তাতেও ব্যাপক প্রভাব পড়ত ৷ অবশেষে 2021 সালের অক্টোবরে ভুটান ও চিন সীমান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনায় রাজি হয় ৷ ফলে এই সব বিতর্কের প্রেক্ষিতে মোদির আগামী ভুটান সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ৷
আরও পড়ুন: