পহেলহগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার কড়া জবাব দিয়েছে ভারত ৷ পাকিস্তান এবং পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের জঙ্গিঘাঁটি ধ্বংস করে দিয়েছে ৷ সবদিক থেকেই অপারেশন সিঁদুর সফল হয়েছে ৷ তবে এই জঙ্গি হামলার জেরে ভারতের সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি যে আরও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তাতে কোনও সংশয় নেই ৷ জঙ্গিরা আগের থেকে অনেক বেশি উন্নত অস্ত্রে সজ্জিত হয়েছে এবং ধর্মীয় আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে ৷ এর পাশাপাশি হাফিজ সইদ থেকে শুরু করে মৌলানা মাসুদ আজাহাররা লাগাতার হামলার হুমকি দিয়ে চলেছে ৷ ভারত-বিরোধী জঙ্গি কার্যকলাপের গড় হয়ে উঠেছে বাংলাদেশও ৷ এমতাবস্থায় শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সঙ্গেই আইনি এবং কূটনৈতিক দিক থেকে পোক্ত নীতি ভারতকে গ্রহণ করতেই হবে ৷
জঙ্গিদের প্রতিহত করা এবং সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা
জম্মু ও কাশ্মীরে জঙ্গিদের প্রবেশ প্রতিহত করা মোটেই সহজ কাজ নয় ৷ ভৌগোলিক কারণে এই উপত্যকার যে সমস্ত এলাকা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করা যায় সেখানে ড্রোন থেকে শুরু করে উপগ্রহের সাহায্যে নজরদারি চালিয়েও একশো শতাংশ সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয় ৷ এই ব্যাপারে সাফল্যের হার বাড়াতে সিন্থেটিক অ্যাপরাচার রেডার থেকে শুরু করে সাইসমিক ও অ্যাকস্টিক সেন্সর এবং হাইপার স্পেকট্রাকাল ইমেজ প্রয়োজন ৷ এই ধরনের সামগ্রী থাকলে আন্তর্জাতিক সীমান্তে থাকা গুহা থেকে শুরু করে ট্যানেল সর্বত্র নজরদারি চালানো সম্ভব ৷ অনুপ্রবেশ করতে এগুলোই ব্যবহার করে থাকে জঙ্গিরা ৷

পহেলগাওঁয়ের ঘটনার ক্ষেত্রে জঙ্গিরা জিওস্পেশাল ইমেজ ব্যবহার করেছিল বলে জানিয়েছে ইন্টারপোল থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপুঞ্জের মতো সংস্থা ৷ 2025 সালে জানুয়ারি মাসে এই ছবি তোলা হয়েছিল ৷ প্রযুক্তির উপর অত্যাধিক নির্ভর করার কয়েকটি কুপ্রভাব আছে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা ৷ তাঁরা মনে করেন প্রযুক্তির উপর অতিরিক্ত নির্ভর করলে একেবারে গ্রাউন্ড জিরোতে গিয়ে জঙ্গিদের সন্ধান করা, তাদের খুঁজে পেতে স্থানীয়দের সাহায্য নেওয়া এবং প্রতি মুহূর্তে কড়া নজরদারি চালানোয় খানিকটা হলেও খামতি থেকে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায় ৷ কিন্তু মাথায় রাখতে হবে অমরনাথ যাত্রার মতো বা ওই ধরনের বিষয়কে সুরক্ষিত রাখতে মাঠে নেমে জঙ্গিদের খুঁজে বের করা খুবই জরুরি ৷
সামরিক প্রস্তুতি
কার্গিল যুদ্ধ নিয়ে পর্যালোচনা করতে তৈরি কমিটির প্রধান কে সুব্রহ্মণ্যম নিজের রিপোর্টে লিখেছিলেন ভারতের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট নীতি তৈরি করা দরকার ৷ এখানে বলতে হবে 2016 সালে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং 2019 সালে বালাকোট এয়ারস্ট্রাইক করে ভারত স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে এলওসি-তে প্রয়োজন পড়লে সেনা ব্যবহার করবে ৷ আর অপারেশন সিঁদুরের পর ভারতের তরফে সরকারিভাবে বলে দেওয়া হয়েছে এখান থেকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপকে যুদ্ধ হিসেবে দেখা হবে ৷ ভারতের উচিত ইজরায়েলের মতো 'ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার'-এর কৌশল রপ্ত করা ৷ পাশাপাশি, গুপ্তচর ব্যবস্থা নতুন করে গঠন করার ক্ষেত্রেও ইজরায়েলই ভারতের আদর্শ ৷ হিজবুল্লার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার মাধ্যমে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে ইজরায়েল ৷ ভারতকে চিন থেকে শুরু করে পাকিস্তান এবং তাদের মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠনের কার্যকলাপ থেকে সতর্ক থাকতে হয় ৷ বিশ্বের মানচিত্রে আর্থিক শক্তি হিসেবে মাথা তুলছে ভারত ৷ আর এমতাবস্থায় শত্রুদের নিকেশ করতে গোপন অপারেশন করতে হবে ভারতকে ৷ এর আগে লস্কর থেকে শুরু করে জইশ-ই-মহম্মদের মতো সংগঠনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়েছে ভারত ৷ পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং কানাডায় খালিস্থানী কার্যকলাপকেও দমন করা হয়েছে ৷

2025 সালের 18 মে দিনটির আলাদা তাৎপর্য রয়েছে ৷ সেদিন অজ্ঞাত পরিচয় বন্দুকবাজদের গুলিতে লস্করের অন্যতম প্রধান কমান্ডার সইফুল্লা খালিদের মৃত্যু হয় ৷ রিসার্চ অ্য়ান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের তরফে ওই ঘটনার দায় নেওয়া হয়নি ৷ তবুও তাদেরকেই দোষী প্রতিপন্ন করা হয়েছে ৷ জানুয়ারি মাসে কানাডায় খালিস্তান পন্থী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকেও খুন করা হয়েছিল ৷ এমনই নানা ঘটনার আবহে ভারত সংসদের একটি কমিটির কাছে প্রকাশ করা বক্তব্যে স্বীকার করে নিয়েছে দেশের শত্রুদের খতম করতে বিদেশেও অপারেশন চালানো হয় ৷
গুপ্ত খবরকে হাতিয়ার করে পাকিস্তানের মদতে ভারতে সন্ত্রাস করে চলা লস্কর থেকে শুরু করে জইশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে দিল্লি ৷ কিন্তু আমেরিকার মতো শত্রুর বিরুদ্ধে গভীর এবং ভয়াবহ আঘাত হানার কৌশল ভারত এখনও রপ্ত করতে পারেনি ৷ আমেরিকা যেভাবে ওসামা বিন লাদেনকে শেষ করেছিল তেমন কিছু করে ভারতের পক্ষে হাফিজ সইদ বা মাসুদ আজহারের মতো চেনা শত্রুকে নিকেশ করা এখনই সম্ভব নয় ৷ সামরিক অভিযান থেকে শুরু করে কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা গঠনের ক্ষেত্রে ভারতের আরও বেশি করে গুপ্ত তথ্য সংগ্রহ করা দরকার ৷ দরকার বিশেষ ধরনের ব়্যাডারেরও ৷ অনুপ্রবেশ রুখতে এই ব্যবস্থা বিশেষ ভূমিকা পালন করবে ৷ পাকিস্তানে ঢুকে আক্রমণ চালাতে যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে হেলিকপ্টারের প্রয়োজন ৷ লাদেনকে নিকেশ করতে ব্যাল্ক হক ব্যবহার করেছিল আমেরিকা ৷ একই পথে হাঁটতে হবে ভারতকেও ৷

অসামরিক প্রস্তুতি
জঙ্গিদের বিরুদ্ধে গভীর আঘাত হানার পাশাপাশি ভারতকে আইনি যুদ্ধের প্রস্তুতিও সেরে রাখতে হবে ৷ একইসঙ্গে তথ্য-যুদ্ধ এবং কূটনৈতিক-যুদ্ধের জন্য দিল্লিকে তৈরি থাকতে হবে ৷
আইন-যুদ্ধ
আইন-যুদ্ধের অর্থ হল আইনি ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে সামরিক, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত অবস্থানকে শক্তপোক্ত করতে হবে ভারতকে ৷ এ পথে অনেক আগেই হাঁটতে শুরু করেছে চিন ৷ 2020 সালের হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইন এবং 2021 সালের উপকূলীয় আইনের মাধ্যমে বেজিং আইনি দিক থেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি সুরক্ষিত হতে পেরেছে ৷ একইভাবে ভারতের উচিত দেশের ভিতরে আইনি ব্যবস্থায় বদল আনা ৷ সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ভারতের কড়া মনোভাব সম্পর্কে দেশের বাইরে লুকিয়ে থাকা জঙ্গিদের কাছে পৌঁছে দিতে এই ব্যবস্থার আলাদা গুরুত্ব আছে ৷ ভারত এখন বলছে সন্ত্রাসবাদকে যুদ্ধ হিসেবে দেখবে ৷ এই পদক্ষেপের সঙ্গে 1986 সালে আইসিজে (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে )-র একটি সিদ্ধান্তের মধ্যে বেশ খানিকটা সাদৃশ্য আছে ৷ নিকারাগুয়ার সঙ্গে আমেরিকার মামলায় আদালত ইউএনজিএ প্রস্তাব এনেছিল ৷ এই প্রস্তাবে বলা ছিল, একদল লোককে ব্যবহার করে কোনও দেশ অন্য দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে না ৷ ভারতও আইনের বলে বলিয়ান হয়ে সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে পাকিস্তানের মুখোশ খুলে দিতে পারে ৷ এই কাজটি করার জন্য অবশ্য আমলাদের আইনি প্রশিক্ষণ দেওয়া একান্ত আবশ্যক ৷
তথ্য-যুদ্ধ
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তথ্য ভারতের বড় হাতিয়ার ৷ সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে পাক-যোগকে গোটা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরতে পারে ভারত ৷ তাতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানের মুখ পুড়বে ৷ কূটনৈতিকভাবেও ইসলামাবাদকে অস্বস্তিতে ফেলা যাবে ৷ পাকিস্তানের ডিজিআইএসপিআর, চিনের গ্লোবাল টাইমস এবং তুরস্কের টিআরটি ভারতের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার করে চলেছে তারও মোকাবিলা করতে তথ্যকেই পুঁজি করতে হবে ভারতকে ৷ বাংলাদেশ, আজারবাইজান থেকে শুরু করে পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমের একটি অংশও ভারতের ভাবমূর্তিতে আঘাত হানার প্রয়াস করে থাকে নিয়মিত ৷ সেসব নিয়ন্ত্রণের জন্যও আলাদা কৌশল অবলম্বন করতে হবে ৷ মিথ্যা প্রচারের মোকাবিলা করতে সাইবার অভিযানে জোর দিতে হবে ৷ ডিজিটাল মাধ্যমকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ কীভাবে চলছে তাও ভারতকে জানতে হবে ৷ অপপ্রচারকে পরাজিত করতে প্রকৃত তথ্য প্রকাশ্যে আনতে হবে ৷ বিদেশে থাকা ভারতীয়রা এই কাজে গতি আনতে পারবেন ৷ পাকিস্তানের কুকর্ম তুলে ধরতে তাঁরা প্রতিনিয়ত ভিডিয়ো থেকে শুরু করে উপগ্রহ চিত্রের মতো প্রমাণ প্রকাশ্যে আনতে সক্ষম হবেন ৷
কূটনৈতিক যুদ্ধ
সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে পাকিস্তানকে জবাব দিতে কূটনীতিকে হাতিয়া করতে পারে ভারত ৷ পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের বক্তব্যকে জোরালো করতে সংবাদমাধ্যমকেও হাতিয়ার করতে হবে ভারতকে ৷ একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝানো যেতে পারে ৷ ব্রিটেনে ভারতের হাই কমিশনার বিক্রম দোসওয়ানি স্কাই নিউজকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের যোগাযোগের কথা তুলে ধরেছেন ৷ এভাবেই জাতিসঙ্ঘ থেকে শুরু করে এফএটিএফ এবং জি20-র মতো মঞ্চে আরও বেশি করে সক্রিয় হতে হবে ভারতকে ৷ ইংল্যান্ড থেকে শুরু করে ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ এবং সার্কের মতো গোষ্ঠীকেও পাশে পেতে হবে ৷ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই সমস্ত দেশ ও গোষ্ঠীকে একত্রিত করতে হবে ৷ এই কারণেই মে মাসের শেষে বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছে ৷
আন্তর্জাতিক স্তরে ভূ-রাজনীতিতে বিরাট বদল এসেছে ৷ এই বদলের সঙ্গে একাত্ম হতে পারার উপর ভারতের বিদেশ নীতীর সাফল্য নির্ভর করছে ৷ পাশাপাশি যুদ্ধের ব্যবস্থাপনায় এআই পরিচালিত ব্যবস্থা থেকে শুরু করে নজরদারি চালাতে তৈরি অত্যাধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে ৷ নিরাপত্তা সংক্রান্ত গোপন খবরাখবর নেওয়ার কাজেও গতি বাড়াতে হবে ৷ ভারতের এলিট ফোর্সকেও কাজে লাগাতে হবে ৷ পাশাপাশি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থাকেও কাজে লাগাতে হবে ৷ তাদের কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের উপর প্রবল চাপ তৈরি করতে হবে ৷
( ডিসক্লেইমার: এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারতের মতামতকে প্রতিফলিত করে না।)