হায়দরাবাদ, 3 এপ্রিল: গত 50 বছরে বিশ্ব একটি কৃষি অর্থনীতি থেকে শিল্প অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং এখন জ্ঞান অর্থনীতির দিকে রূপান্তরিত হচ্ছে । একটি জ্ঞান অর্থনীতিতে উদ্ভাবন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি (আইপি) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । এইভাবে উদ্ভাবন অর্থনৈতিক অগ্রগতি, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং সমাজের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব এবং প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত ।
উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার জন্য পেটেন্টগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং পেটেন্ট অনুদান আর এন্ড ডি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে, প্রযুক্তি স্থানান্তরকে সহজ করে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত নেতৃত্বের প্রচার করে । বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি (আইপি) নিবিড় শিল্পগুলি একটি অর্থনীতিতে আউটপুটের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, জিডিপি হিসাবে পরিমাপ করা হয় এবং কর্মসংস্থান ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতার দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক ।
ভারতের লক্ষ্য আগামী কয়েক বছরের মধ্যে 5 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনীতি এবং 2047 সালের মধ্যে 35 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনীতিতে পরিণত হওয়া, যা জাপান এবং জার্মানিকে ছাড়িয়ে যাবে ৷ এর অর্থ ভারতে মাথাপিছু আয় 26000 মার্কিন ডলার হাজার হবে, যা বর্তমান স্তরের প্রায় 13 গুণ । ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়া কেবল তখনই সম্ভব যখন দেশ আইপি-নিবিড় শিল্পগুলির দিকে মনোয়োগ দেবে এবং জিডিপিতে তার অবদান বাড়াবে ৷ এর ফলে ভারতের আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করা হবে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে শিল্পগুলি নিবিড়ভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সুরক্ষা ব্যবহার করে তারা জিডিপির 41 শতাংশ এবং কর্মশক্তির এক তৃতীয়াংশের বেশি । তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা কেবল তখনই সম্ভব যদি আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চ্যালেঞ্জ এবং সমস্যাগুলি মোকাবিলা করি । উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা এক নম্বরে থাকে ৷ সেখানে 2024 সালের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সূচক অনুসারে ভারত 42তম স্থানে রয়েছে ।
গোটা বিশ্বের ছবি:
বিশ্বব্যাপী 2013 এবং 2023 সালের মধ্যে আইপিআর অ্যাপ্লিকেশনের বৃদ্ধি সিএজিআর-এর 60 শতাংশের বেশি ৷ এর মূল কারণ হল পেটেন্ট এবং শিল্প নকশার বৃদ্ধি । রিপোর্ট অনুযায়ী, 2014-2023 সালের মধ্যে প্রকাশিত পেটেন্টের ব্যতিক্রমী সংখ্যা 4.65 লাখে দাঁড়িয়েছে, যা 2004-2013 সালে প্রকাশিত হওয়াগুলির চেয়ে 44 শতাংশ বেশি ।
উল্লেখযোগ্য দেশ:
ডব্লুআইপিও রিপোর্ট 2023 অনুযায়ী, পেটেন্টের সংখ্যার দিক থেকে চিন সবচেয়ে উপরে ৷ এই দেশের পেটেন্টের সংখ্যা 1 কোটি 6 লক্ষ 19 হাজার 268 ৷ যেখানে বৃদ্ধির হার 2.1 শতাংশ ৷ এরপরেই রয়েছে আমেরিকা ৷ পেটেন্টের সংখ্যা 5 লক্ষ 94 হাজার 340 ৷ 0.5 শতাংশ বৃদ্ধির হার । তারপর জাপান 2 লক্ষ 89 হাজার 530-সহ তৃতীয় অবস্থানে এবং কোরিয়া 2 লক্ষ 37 হাজার 633, 0.2 শতাংশ হারে চতুর্থ অবস্থানে ৷ পঞ্চম স্থানে ইউরোপীয় পেটেন্ট অফিস ৷ যার 2.6 শতাংশ বৃদ্ধির হার-সহ পেটেন্টের সংখ্যা 1 লক্ষ 93 হাজার 610 ৷ এরপরে ষষ্ঠ বৃহত্তম পেটেন্ট ভারতের, বৃদ্ধির হার 17 শতাংশ ।
আইপিআরে ভারতের বৃদ্ধি:
গত দশ বছরে গড়ে 25.2 শতাংশ বৃদ্ধির সঙ্গে ভারতের যাত্রা উল্লেখযোগ্য এবং এটি চিনকে ছাড়িয়ে যাওয়া দ্রুততম দেশ । গত দশ বছরে পেটেন্ট আবেদনের মোট সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে । 2013-14 সালে মোট আবেদনের সংখ্যা ছিল 42591টি, যার মধ্যে শুধুমাত্র 10941টি ভারতীয়রা করেছে । পেটেন্ট আবেদনের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধির সাক্ষী থাকছে ভারত । নয় বছরে অর্থাৎ 2022-23 সালে মোট আবেদনের সংখ্যা বেড়ে 82,811 হয়েছে, যার মধ্যে 43,301টি ভারতীয়রা পূরণ করেছে । এইভাবে ভারতীয়দের অংশ 2013-14 সালে 25.69 শতাংশ থেকে 2022-23 সালে 52.29 শতাংশ বেড়েছে ।
একইভাবে প্রদত্ত পেটেন্টের সংখ্যা 2013-14 সালে পূরণকৃত মোট আবেদনের 9.92 শতাংশ থেকে 2022-23 সালে 41.22 শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে । তথ্য অনুযায়ী, ভারতে 2023 সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত 8.40 লক্ষ পেটেন্ট প্রকাশিত হয়েছে ৷ এইভাবে, আগের দশকে 2004-2013 পর্যন্ত 89টি পেটেন্টের তুলনায় 2014-15 থেকে 2022-23 সাল পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন 127টি পেটেন্ট প্রকাশিত হয়েছে ৷ মোট 2.30 লক্ষ আবেদনকারী ভারতীয় ৷ তারপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের নাগরিক রয়েছে ।
খাতগত উদ্ভাবন:
গড়ে ঐতিহ্যগত ক্ষেত্র যেমন যান্ত্রিক এবং রসায়ন-সম্পর্কিত উদ্ভাবনগুলি যথাক্রমে 20 শতাংশ এবং 16 শতাংশ । কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক্স এবং যোগাযোগ সেক্টরের মতো নতুন যুগের প্রযুক্তিগুলি যথাক্রমে 11 শতাংশ, 10 শতাংশ এবং 9 শতাংশ । টেক্সটাইল, খাদ্য এবং সিভিল সেক্টর প্রতিটিতে উদ্ভাবনের মাত্র 1 শতাংশ ।
রাজ্যে উদ্ভাবন:
উল্লেখযোগ্যভাবে, উত্তরপ্রদেশ 2013-14 থেকে 2022-23 পর্যন্ত 7.2 শতাংশ শেয়ারের সঙ্গে গুজরাত এবং তেলেঙ্গানাকে ছাড়িয়ে রাজ্যগুলির মধ্যে এখন এগিয়ে রয়েছে ৷ তবে পঞ্জাব রাজ্যের শেয়ার 5.8 শতাংশ-হ স্থিতিশীল এবং চিত্তাকর্ষক হয়েছে গুজরাত তার উদ্যোক্তা মনোভাবের জন্য পরিচিত ৷ কিন্তু শেয়ারের মাত্র 4.6 শতাংশ এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে । গত দশ বছরে তেলেঙ্গানা সরকার রাজ্য জুড়ে শিল্প পরিকাঠামোকে রূপান্তরিত করেছে এবং ফলস্বরূপ 2004 - 2013 সালের মধ্যে এর অংশ 1 শতাংশ থেকে 2014 - 2023 এর মধ্যে 4 শতাংশে বেড়েছে ।
রাজ্যটি তার আইপি ইকোসিস্টেমকে উন্নত করতে আরও অনেক কাজ করতে পারে । সবচেয়ে কম শেয়ার ছোট রাজ্য হিমাচল প্রদেশের, যার 0.3 শতাংশ শেয়ার রয়েছে । দুর্ভাগ্যবশত, বৃহত্তম রাজ্যগুলির মধ্যে একটি অন্ধ্রপ্রদেশ এই তালিকায় জায়গা করে নিতে পারিনি ৷ স্পষ্টতই এই রাজ্যে তালিকায় হিমাচল প্রদেশের চেয়ে নীচে অবস্থান করছে ।
কারণ সমূহ:
ভারত কীভাবে তার বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি বাস্তুতন্ত্রকে রূপান্তরিত করেছে তা জানা উত্তেজনাপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ । ভারতের আইপি শাসন 2013 সালের আগে অকার্যকর এবং অদক্ষ বলে পরিচিত ছিল । তবে 2014 সালের পরে অর্থাৎ মোদির সরকারের মেয়াদে ভারতে আইপি শাসন প্রাণবন্ত হয়েছে, যার জন্য জিওআই দ্বারা প্রবর্তিত প্রশাসনিক এবং আইনী সংস্কারকে বাহবা দেওয়া যেতে পারে । সাধারণত রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের লক্ষ্যে যে কোনো সংস্কার কাঙ্খিত ফলাফলের ফলস্বরূপ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে । তবে মোদি সরকার কর্তৃক শুরু করা আইপি-সম্পর্কিত সংস্কারের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি ৷ বাস্তবায়নের ব্যবধান সময় কম হওয়ায় দ্রুত ফল দিয়েছে ৷
প্রশাসনিক সংস্কার:
ভারত সরকার আইপি শাসনে রূপান্তরমূলক পরিবর্তন আনতে দ্বিগুণ পদ্ধতি অনুসরণ করেছে ৷ একটি হল প্রশাসনিক সংস্কার, যার লক্ষ্য সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের দক্ষতা উন্নত করা এবং আমলাতন্ত্রকে হ্রাস করা । পেটেন্ট মঞ্জুর করার জন্য আবেদন করার গড় সময় ছিল 2013 সাল পর্যন্ত 68.4 মাস ৷ দশ বছরে সেটি 15 মাস হ্রাস করা হয়েছে । আমরা সবাই জানি পেটেন্ট মঞ্জুর করার জন্য আবেদনের তারিখ থেকে নেওয়া সময় প্রতিটি ডোমেইন এলাকার জন্য আলাদা । সরকার প্রশাসনিক সময় প্রক্রিয়াকরণের আবেদন ফাইলিং থেকে মঞ্জুরি পর্যায়ে ব্যাপকভাবে হ্রাস করেছে । উদাহরণস্বরূপ, রসায়ন-সম্পর্কিত পেটেন্টের ক্ষেত্রে 2014 সালের আগে 64.3 মাস সময় নেওয়া হয়েছিল এবং এখন এটি 30.9 মাসে কমিয়ে 33.5 মাসে হ্রাস করা হয়েছে । একইভাবে পলিমার-সম্পর্কিত পেটেন্ট অনুদানের সময় 35.5 মাস হ্রাস পেয়েছে ।
আইনী সংস্কার:
পেটেন্ট (সংশোধন) বিধি 2016 অনুযায়ী সরকার স্টার্টআপ আবেদনকারীদের জন্য একটি নতুন বিভাগ চালু করেছে ৷ এতে স্টার্টআপগুলির ফি-তে 80 শতাংশ ছাড় বাড়ানো হয়েছে । একইভাবে পেটেন্ট (সংশোধন) বিধি 2019-এ, সরকার ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলিকে কিছু ছাড় দিয়েছে । পেটেন্ট (সংশোধন) বিধি 2020 এবং 2021-এ, সরকার ছোট সংস্থা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য 80 শতাংশ ফি হ্রাস করেছে ।
পেটেন্ট (সংশোধন) বিধি 2024 পেটেন্ট প্রাপ্তি এবং পরিচালনা সহজতর করার জন্য বিধান প্রবর্তন করেছে, উদ্ভাবক এবং নির্মাতাদের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশের সুবিধা প্রদান করেছে । নিয়মের পরিবর্তনের লক্ষ্য হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা ৷ যাতে বিকশিত ভারত সংকল্প অর্জন করা যায়, যা ভারতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করবে এবং 2047 সালের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি হবে 35 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ।
আইপি ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রশাসনিক এবং আইনী সংস্কারের মতো জিওআই উদ্যোগগুলি প্রশংসনীয় এবং উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করার জন্য ভারতের সক্রিয় পদ্ধতির গুরুত্ব তুলে ধরে । দ্রুত, সহজ এবং আরও দক্ষ আইপি ব্যবস্থা শুধুমাত্র ভারতীয় নির্মাতা এবং উদ্ভাবকদেরই উৎসাহিত করে না, বরং মেধা সম্পত্তি অধিকার সুরক্ষার বৈশ্বিক ল্যান্ডস্কেপেও অবদান রাখে ।
(এটি লেখকের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত ৷ লেখার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের কোনও সম্পর্ক্য নেই )
তথ্য সূত্র: এসবিআই রিসার্চ রিপোর্ট এবং ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি ইন্ডিয়া
আরও পড়ুন: