পরাজিত পক্ষ সবসময় নিজের সামান্য প্রাপ্তিকে বিরাট জয় বলে চালাবার চেষ্টা করে ৷ যারা গায়ের জোরে দেশ শাসন করে তাদের নাগরিকদের কাছে মুখরক্ষায় দায় আছে বলে এই প্রয়োজন আরও বাড়ে ৷ মুখরক্ষার লড়াই চালিয়ে যেতে হয় আন্তর্জাতিক মঞ্চেও ৷ জয়ীদেরও শান্তি রক্ষার্থে পরাজিতদের সন্তুষ্ট রাখতে সামান্য সুযোগ দিতে হয় ৷
পরাজিতকে আরও কোণঠাসা করার প্রয়াস সংঘাত কমানোর বদলে বাড়িয়ে দেয় ৷ পাশাপাশি জয়ী পক্ষও জানে তাদের যা পাওয়ার ছিল তা পাওয়া হয়ে গিয়েছে ৷ পরাজিত পক্ষ মুখ বাঁচাতে কী বলল তার কোনও প্রভব পড়বে না ৷ ভারত ও পাকিস্তানের ডিজিএমওদের সাংবাদিক বৈঠক অবশ্য সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবনার প্রতিফলন ৷
পরাজিতর মিথ্যা আর বিজয়ীর সত্যের মধ্যে ফাঁক আরও বড় বিপদের কারণ হয়ে থাকে ৷ বিশেষ করে সোশাল মিডিয়া থেকে যাঁরা নিজেদের মতামত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন তাঁরা এই দুই বক্তব্যের কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল তার প্রভেদ করতে পারেন না ৷ তাঁরা কাকে সমর্থন করছেন সেটাও এখানে বড় ভূমিকা নিয়ে থাকে ৷ নিরপেক্ষ এমন অংশের সংখ্যা খুবই কম ৷ অপারেশন সিঁদুর এই সত্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়েছে ৷
আদর্শের দিক থেকেই ভারতের কাছে হার পাকিস্তান মেনে নিতে পারে না ৷ খেলার মাঠ হোক অথবা অপারেশন সিঁদুর-এ কথা সব জায়গাতেই খাটে ৷ যুদ্ধক্ষেত্রে জিততে না পারলেও সোশাল মিডিয়ায় তারা এমন প্রচার অবশ্যই করবে যাতে মনে হয় তারাই জিতেছে ৷ নিজেদের বড় করে দেখাতে অসত্য এমন বক্তব্যই তুলে ধরবে ৷ সেই বিচারে অপারেশ সিঁদুর নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় দুধরনের আলোচনা দেখা গিয়েছে ৷ একপক্ষ সত্য ঘটনা তুলে ধরেছে আর অন্য পক্ষ মিথ্য়া দাবি করে নিজেদের বড় করে দেখাতে চেয়েছে ৷ যুদ্ধ জয়ের মিথ্যা দাবি করেছে ৷

অপারেশন সিঁদুরের প্রথম দিন থেকেই পাকিস্তান মিথ্যা প্রচার করেছে ৷ বোঝাবার চেষ্টা করেছে, ভারতীয় সেনাকে তারা পরাজিত করেছে ৷ এই প্রথম নয়, দশেকর পর দশক ধরে অপ্রপচার করার ব্যাপারে পাকিস্তান সিদ্ধহস্ত ৷ সাফল্যের সঙ্গে এই কাজ করতে তাদের বেশ কিছু পাকামাথা আছে ৷ ভালোভাবে মিথ্যা প্রচার করতে যুব সম্প্রদায়কে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় ৷
পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর একটি শাখা জনসংযোগের কাজ করে ৷ সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে ৷ এই শাখার নাম আইএসপিআর ৷ এই শাখার ডিজির নেতৃত্বে কমবয়সিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় নিয়মিত ব্যবধানে ৷ চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে এভাবেই 2500 ছেলেমেয়েকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল ৷ এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন থেকে প্রশিক্ষণের ব্যাপারে কয়েকটি তথ্য জানা যায় ৷ কোনও সঙ্কটের সময় কীভাবে সেনার ভাবমূর্তি রক্ষা করতে হবে সেটাই এখানে শেখানো হয় ৷ অপারেশন সিঁদুরের সময় পাক-সেনার ভাবমূর্তি রক্ষার ভার ছিল এই সমস্ত ছেলেমেয়েদের উপরই ৷
ভারতীয় সেনার এমন কোনও শাখা নেই ৷ কারণ, সত্য গোপনের প্রয়োজনই নেই ৷ অপারেশ সিঁদুরের প্রতিটি পদক্ষেপে সাংবাদিক বৈঠক করে বিভিন্ন তথ্য জানানো হচ্ছিল ৷ তার সপক্ষে প্রমাণও দেওয়া হচ্ছিল ৷ কোথায় কোথায় হামলা হয়েছে এবং তা থেকে কী কী ফল পাওয়া গিয়েছে সেটা সবিস্তারে বলা হচ্ছিল ৷ কোনও কোনও ঘটনায় প্রমাণ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি ৷ আর তাই সেগুলির ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্যও দেওয়া হয়নি ৷ শুধু ঘটনাটির কথা তুলে ধরা হয়েছে ৷ পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান ধ্বংস করার ব্যাপারটিকে উদাহরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে ৷ আর এই সামরিক অভিযানের বিষয় শুরু থেকেই পাকিস্তানের তরফে যে সমস্ত সাংবাদিক বৈঠক করা হয়েছে সেগুলি কার্যত মশকরার সামিল ৷ তাদের দাবিগুলো শুধুই অতিরঞ্জিত ছিল না তা নয় ৷ দাবির সপক্ষে কোনও প্রমাণও পর্যন্ত দেওয়া হয়নি ৷ আবার সেই সমস্ত দাবি অনেকাংশেই অবোধ্যও বটে ৷ আদতে পাকিস্তানের বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম আইএসআই প্রভাবিত ৷ তাছাড়া সেখানে যে সমস্ত সংবাদ প্রকাশিত হয় তার পুরোটাই সেনার উপর নির্ভর করে, সেনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় ৷ এর ফলে স্থানীয়দের মতামত প্রভাবিত করা যায় ৷ পাকিস্তানের নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার ভারত বিদ্বেষকে আবেগের পর্যায়ে নিয়ে যাওযা যায় ৷

তাদের নিজেদের দেশের এবং দেশের বাইরে থাকা নাগরিকদের প্রভাবিত করতে সোশাল মিডিয়ায় অপ্রপচার করেছে ইসলামাবাদ ৷ দাবি করেছে তারা উদমপুরের বায়ুসেনা ঘাঁটিতে থাকা ভারতের এস 400 এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ধ্বংস করেছে ৷ সেটাকে তাদের বিরাট জয় হিসেবে দেখানো হয়েছে ৷ সংঘাতের পর উদমপুরে গিয়ে ওই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে গোটা দুনিয়ার কাছে পাকিস্তানের মিথ্যার পর্দা ফাঁস করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৷ পাকিস্তানের সোশাল মিডিয়ায় কী ধরনের মিথ্যা প্রচার হয় এটা তারও একটা প্রমাণ ৷
ভারতের যুদ্ধবিমান ধ্বংস করা নিয়েও তারা মিথ্যাচার করেছে ৷ কখনও দাবি করেছে তারা দুটি বিমান ধ্বংস করেছে ৷ কখনও আবার সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ছয় ৷ কিন্ত বিকৃত করা ভিডিয়ো ছাড়া আর কোনও তথ্য তারা প্রমাণ হিসেবে দেখাতেও পারেনি ৷ এই বিষয়ে সিএনএনরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খোয়াজা আসিফ দাবি করেন, পাক-হামলায় ভারতের যুদ্ধবিমান ধ্বংস হওয়া কথা সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে ৷ সেটাই তার প্রমাণ ৷ সঞ্চালক অন্য প্রমাণ দেখাতে বললে, প্রশ্নটি ভালো করে শুনতে পাননি এমন ভাব করে উত্তর এড়িয়ে যান ৷
ভারতের কাছে সংঘর্ষ বন্ধের অনুরোধ যে তারাই আগে জানিয়েছিল সে কথাও পাকিস্তান চেপে গিয়েছে ৷ ভারতের আক্রমণে পাকিস্তানের বায়ুসেনা ঘাঁটির প্রবল ক্ষতি হয়েছিল ৷ ভেঙে পড়েছিল এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ৷ এই দুটি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থার মূল ভিত্তি ৷ পাকিস্তান বুঝতে পারে এরপরও সংঘর্ষ চললে আরও বড় ক্ষতির মুখে পড়তে হবে ৷ ইসলামাবাদের সমস্যা আরও বাড়বে ৷ 'জিহাদি' সেনাবাহিনীর জন্য সংঘর্ষ বিরতি করতে বলা আত্মসমর্পণ করার সামিল ৷
মিথ্যা প্রচারের সাহায্যে পাকিস্তান সোশাল মিডিয়ায় বোঝাতে চেয়েছে তাদের দিক থেকে সমঝোতার প্রস্তাব আসেনি ৷ প্রস্তাব দিয়েছে আমেরিকা ৷ নাগরিকদের কাছে মুখরক্ষা করতে হলে বলা ভালো তাদেল সামনে নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে গেলে এই মিথ্যা প্রচার করা ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই ৷ পাকিস্তানের নেতারা সংঘর্ষ বিরতির ব্যাপারে আমেরিকাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ৷ আবার ভারতকে সংঘর্ষ বিরতির প্রস্তাব দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছে বিদেশ মন্ত্রক ৷
পাকিস্তানের ডিজিএমও-র সঙ্গে হটলাইনে কী কথা হয়েছে সেটা ভারতের ডিজিএমও স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন ৷ পাকিস্তানকে অসম্মান না করে যা বলার তা বলেছেন ৷ দু'জনের মধ্যে কী কথা হয়েছে তা রেকর্ড করা হয়নি এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই ৷ সেটা প্রকাশ্যে আনাও সম্ভব ৷ যদিও ভারত নীরব থেকে পাকিস্তানকে নিজের নাগরিকদের কাছে মুখ বাঁচানোর সুযোগ করে দিয়েছে ৷
নিজেদের জয়ের মিথ্যা প্রচার করতে বিকৃত ভিডিয়ো থেকে শুরু করে ডিপফেক ভিডিয়ো এমনকী ভিডিয়ো গেমের একাধিক ক্লিপিংও ব্যবহার করেছে পাকিস্তান ৷ ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার নাম করে মিথ্যা তথ্যও প্রচার করা হয়েছে ৷ সামরিক মহড়ার পুরনো ভিডিয়ো নতুন বলে চালাতেও তাদের আটকায়নি ৷ ভিন দেশের ভিডিয়োকেও কাজে লাগিয়েছে অনায়াসে ৷
ভারতীয় সেনার তরফে যে সমস্ত সাংবাদিক বৈঠক করা হয়েছে সেগুলিকেও বিকৃত করে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করেছে ৷ দেশের লোকেদের বোঝাতে চেয়েছে ভারত নাকি হার স্বীকার করে নিয়েছে ৷ ভারতের ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান তুলে ধরতে সিএনএনের নাম করে মিথ্যা প্রতিবেদনও দেখানো হয়েছে ৷ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে পাকিস্তানের সাংবাদিকরা কাজ করেন ৷ তাঁরা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করেছেন ৷ তাঁদের খবর পাকিস্তানের প্রচারের অঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে ৷ পাকিস্তান যা যা বোঝাতে চেয়েছে সেগুলি যে যথার্থ তা প্রমাণ করার কাছ করেছে শয়ে শয়ে সোশাল মিডিয়া হ্যান্ডেল ৷

চিন এবং তুরস্কের সাহায্য পেয়েছে পাকিস্তান ৷ তুরস্কের সরকারি সংবাদ মাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ড এবং সংবাদসংস্থা অ্যানাডলুর পাশাপাশি চিনের গ্লোবাল টাইমস পাকিস্তানের ব্যাখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশন করেছে ৷ এ কাজ তারা কেন করেছে তা বুঝতে সমস্যা হওযার কথা নয় ৷ অপারেশন সিঁদুরে পাকিস্তানের ব্যবহৃত অস্ত্র থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করেছিল এই দুটি দেশ ৷ তুরস্কের বহু মিসাইল ভারত ধ্বংস করেছে ৷ আবার চিনের ব়্যাডার ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা সময় থাকতে পাকিস্তানের বাহিনীকে জানাতে পারেনি ৷ এই ব্যর্থতা চিন এবং তুরস্কের জন্য ধাক্কা ৷ অস্বস্তি কাটানোর সহজ উপায় ভারতের পরাজয় সংক্রান্ত মিথ্যা প্রচার করা ৷ তাদের অস্ত্র দিয়ে ভারতকে কাবু করা গিয়েছে সেটা বললে মুখরক্ষা হয় বটে ৷
এই দুটি দেশ জানে আন্তর্জাতিক স্তরে তাদের তৈরি অস্ত্রের বিকল্প হতে পারে ভারত এবং রাশিয়ার অস্ত্র ৷ কারণ, এই দুটি দেশের তৈরি অস্ত্র যুদ্ধে সাফল্য পেয়েছে ৷ বিশ্ব-বাজারে ভারতের নিজের তৈরি অস্ত্রের চাহিদা বাড়বে ৷ নিজেদের উপর তৈরি হওয়া চাপ থেকে মুক্তি পেতে পাকিস্তানকে দোষ দেওয়ার খেলা শুরু হল বলে ৷ বলা হবে, পাকিস্তান ঠিক করে অস্ত্র ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে ৷
মিথ্যা রটানেো সবে শুরু হয়েছে ৷ আগামিদিনে আরও অনেক বেশি পরিমাণে মিথ্যা ভিডিয়ো থেকে শুরু করে ক্লিপিং সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে ৷ বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন ছাপা হবে ৷ ভারতের সঙ্গে সামরিক সংঘাতে পাকিস্তান যে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে তা ফলাও করে প্রচার করা হবে ৷ ভারত কিন্তু চুপ থাকবে ৷ কারণ, দিল্লি জানে সংঘাতের ব্যাপারে যাঁদের কাছে সঠিক তথ্য থাকা দরকার তাঁদের কাছে সেটা অবশ্যই আছে ৷ মাত্র তিনদিনের মধ্যে ভারত যে সাফল্য় পেয়েছে সেটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানে ৷ ভারতের নাগরিকরা যাতে পাকিস্তানের মিথ্যার দ্বারা প্রভাবিত না হয় সেটা অবশ্য খেয়াল রাখা দরকার ৷
( ডিসক্লেইমার: এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারতের মতামতকে প্রতিফলিত করে না।)