অপারেশন সিঁদুরের পরাজয় ঢাকতে দুটি পদক্ষেপ করেছে পাকিস্তান ৷ সে আলোচনায় যাওয়ার আগে মনে রাখা দরকার ভারতের সঙ্গে সংঘাতের সময় তারাই সংঘর্ষ বন্ধ করার অনুরোধ করেছিল ৷ অপারেশন সিঁদুরের পাশাপাশি তারা যে অপারেশন বানিয়ান মাসুস শুরু করেছিল সেটাকে নিজেদের সাফল্য হিসেবে তুলে ধরার কাজও করছে পাকিস্তান ৷ এছাড়া আরও দুটো কাজ তারা করছে ৷ এক, সেনা প্রধান আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শাল করেছে ৷ আর দুই, ভারতের বিরুদ্ধে একাধিক মিথ্যা অভিযোগ করেছে ৷ একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের সম্পর্কে মিথ্যা প্রচারও চালিয়ে গিয়েছে ৷
উইলিয়াম জসেফ স্লিমের লেখা 'ডিফিট ইন্টু ভিক্ট্রি' শীর্ষক বইতে যা বলা হয়েছে সে কথা বাস্তবে প্রয়োগ এক পাকিস্তান ছাড়া আর কোনও দেশই করেনি ৷ ঐতিহাসিকভাবে এটাই সত্যি বলে উঠে এসেছে ৷ 1948 সালে ভারতীয় সেনার হাতে মার খেয়ে পাকিস্তান দিশাহারা হয়েছিল ৷ পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু সংঘাতের বিষয়টিকে রাষ্ট্রপুঞ্জে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন ৷ ততদিনে কাশ্মীরের কয়েকটি অংশের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়েছিল পাকিস্তান ৷ এই দখল করে নেওয়াকে নিজেদের বিরাট জয় হিসেবে দেখিয়েছে পাকিস্তান ৷ 1971 সালে ভারত-পাক যুদ্ধে আত্মসমর্পণের একদিন আগেও জেনারেল ইয়াইয়া খান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সামরিক অভিযানে ভারতের বিরাট ক্ষতি হয়েছে ৷ পাকিস্তান যুদ্ধ জয়ের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছে ৷ একদিন পরেই হার স্বীকার করতে হয় পাকিস্তানকে ৷ তাদের মিথ্য়া গোটা দুনিয়া জানতে পারে ৷

1999 সালে কার্গিলে ভারতের কাছে পাকিস্তানের বড় হার হয় ৷ এই যুদ্ধে হারার পরও পারভেজ মুশারফ পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করেন ৷ আদতে যুদ্ধে ব্যর্থতার জন্য তাঁকে অপাসরণ করা উচিত ৷ কার্গিলের লড়াইয়ে বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছে ৷ তাছাড়া পাকিস্তানকে চরম লজ্জার মুখোমুখি হতে হয়েছে ৷ কিন্ত অপসারণ দূরের ব্যাপার পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন মুশারফ ৷ নির্বাসনে যাওায়ার আগে পর্যন্ত সেই পদেই বহাল ছিলেন তিনি ৷
পাকিস্তানের সাম্প্রতিকতম পদক্ষেপ হল অপারেশন সিঁদুরের পরাজয়ের পর আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শাল হিসেবে প্রোমোশন দেওয়া ৷ শেহবাজ শরিফ এবং তাঁর মন্ত্রিসভা যে মুনিরের অনুগত সে কথা আবারও বোঝা গেল ৷ ফিল্ড মার্শাল করা সংক্রান্ত ক্যাবিনেট নোটে বলা আছে, দূরদর্শী নেতৃত্ব দেওয়া এবং যুদ্ধের কৌশলে মুন্সিয়ানা দেখানোর জন্যই তাঁকে এই পদ দেওয়া হয়েছে ৷ আরও বলা হয়েছে, আসিমর সাহসী নেতৃত্বের জন্যই ভারতকে হারিয়েছে পাকিস্তান ৷ আদতে যে দেশ অন্য দেশের কাছে নতজানু হয়ে সংঘর্ষ বন্ধ করার অনুরোধ করে তাদের কেউ সাহসী নেতৃত্ব দিয়েছেন সেটা কল্পনা করাও মশকরা ৷ এটাও মাথায় রাখতে হবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যখন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তখন আসিফ মুনির নিজে নিরাপদ বাঙ্কারে থাকাই শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন ৷

মুনিরের সঙ্গে আয়ুব খানের কিছু মিল আছে ৷ আয়ুব নিজেই নিজেকে ফিল্ড মার্শালের খেতাব দিয়েছিলেন 1959 সালে ৷ একটি লড়াইয়ের পর ব্রিটিশ রীতি মেনে তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন ৷ মুনির আবার ফিল্ড মার্শাল হওয়ার জন্য নিজেই নিজের নাম সুপারিশ করেন ৷ শেহবাজ শরিফরা সেই সুপারিশকে অনুমোদন করেছেন মাত্র ৷ এখানে বলে রাখা দরকার আযুব বা মুনির-কারও ফিল্ড মার্শাল হওয়ার যোগ্যতা নেই ৷
দ্বিতীয় পদক্ষেপ হল ভারতকে দোষ দিয়ে একটি তথ্য প্রকাশ করা ৷ পাক-সরকারের ডসিয়ারে পহেলগাওঁয়ে হামলার জন্য ভারতকেই দায়ী করা হয়েছে ৷ আরও বলা হয়েছে, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্সের সফরের সময় বেছে নিয়ে এই ঘটনা ভারত ঘটিয়েছে যাতে গোটা দুনিয়ার দৃষ্টি তারা আকর্ষণ করতে পারে ৷ শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের উপরে সামরিক অভিযানকে যাতে যথার্থ বলে দেখানো যায় তাই এই হামলা ৷ এখানেই শেষ নয়, পাক-সরকারের আরও দাবি, ভারতের এই পদক্ষেপের নেপথ্যে দেশের সুরক্ষার বিষয়টি যত বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে রাজনৈতিক সমীকরণ ৷ বিরোধীদের চাপে রাখতে ভারতের শাসক শিবির এই পথে হেঁটেছে বলে দাবি করা হয় ৷

নিজেদের দাবিকে যথার্থতা দিতে পুলওয়ামা হামলার সময় যে সমস্ত ভারতীয় রাজনৈতিক নেতা এবং সাংবাদিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন তাঁদের নাম ও বক্তব্য় এখানে ব্যবহার করে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে ৷ বাস্তবে পাকিস্তানের মদত পাওয়া জঙ্গিরা পর্যটকদের ধর্ম পরিচয় জানার পর হত্যা করেছে ৷ কোনও 'ফ্ল্য়াগ অপারেশন' এভাবে সংগঠিত হতে পারে না ৷
পাকিস্তান জানিয়েছে, অপারেশ সিঁদুর করে ভারত মসজিদে আক্রমণ করেছে ৷ সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করেছে ৷ কিন্তু পাক-সেনার লেফট্যানেন্ট জেনারেল ফায়াজ হুসেন শাহ, মেজর জেনারেল রাও ইমরান সারতাজ এবং ব্রিগেডিয়ার মহম্মদ ফুরকান সাব্বির ভারতের হানায় মৃত জঙ্গিদের শেষকৃত্যে কেন অংশ নিলেন সেটা জানতে পারেনি ইসলামাবাদ ৷ লস্কর-ই-তৈবার সদর দফতর মুরিদকেতে হামলা চালায় ভারত ৷ সেই হামলায় ওই সমস্ত জঙ্গিদের প্রাণ যায় ৷ শেষকৃত্যের সময় জঙ্গিদের দেহের উপর পাকিস্তানের পতাকাও রাখা হয়েছিল ৷ শেষকৃত্যের প্রার্থনার দায়িত্বে ছিলেন লস্করের কুখ্যাত জঙ্গি আব্দুল রাউফ ৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাকে জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করেছে ৷ আমেরিকা মাথার দাম পর্যন্ত রেখেছে ৷ পাকিস্তানের ডিজিআইএসপিআর আব্দুল রাউফকে জঙ্গি নয়, সাধারণ নাগরিক বলে চালানোর প্রয়াসও করেছে ৷

নিজেদের তথ্যে কয়েকটি মৃতদেহের ছবি দেখিয়েছে পাকিস্তান ৷ এই সমস্ত ছবি দেখিয়ে ইসলামাবাদ বলতে চায় এঁরা সকলেই ভারতের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ৷ তবে মৃতদের কোনও পরিচয়ও প্রকাশ্যে আনা হয়নি ৷ একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যাঁদের ছবি দেখানো হচ্ছে তাঁরা খুব সম্ভবত বালুচিস্তানের বাসিন্দা ৷ আর তাঁদের প্রাণ গিয়েছে পাক-সেনার হাতে ৷ সংঘাতের সময় ভারতীয় সেনার তরফে সাংবাদিক বৈঠক করে অভিযানের বিষয় বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে ৷ সেখানে হামলার বিস্তারিত বিবরণের পাশাপাশি প্রমাণও দেওয়া হয়েছে ৷ সে দেশের সমস্ত সংবাদ মাধ্যম অবশ্য পাকিস্তানের বলা মিথ্যাই প্রচার করেছে ৷ কারণ ডিজিআইএসপিআরের অনুমোদন ছাড়া কোনও সংবাদ পরিবেশন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয় ৷ আন্তর্জাতিক স্তরে অবশ্য এই মিথ্যা ধরা পড়ে গিয়েছে ৷
ডসিয়ারে পাকিস্তানের আরও দাবি, সামরিক অভিযানে তারা ভারতের প্রচুর ক্ষতি করেছে ৷ যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে আনর্মাড এরিয়াল ভেহিক্যাল নাকি ধ্বংস করেছে ৷ আদমপুর এবং ভুজে থাকা মিগ 29 থেকে শুরু করে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমেও তারা আঘাত হেনেছে বলে দাবি করেছে ৷ ভারতের 84টি ড্রোন ধ্বংস করার দাবিও তারা করেছে ৷

নিজেদের দাবির সমর্থনে 'সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে' বলা ছাড়া আর কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি পাকিস্তান ৷ সোশাল মিডিয়ার প্রসঙ্গ অন্য কেউ নন খোদ পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খোয়াজা আসিফ বলেছেন ৷ সংঘাত থামার অব্যবহিত পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আদমপুরে গিয়েছেন ৷ এস 400-র সামনে দাঁড়িয়ে ছবি পর্যন্ত তুলেছেন ৷ পাকিস্তানের প্রতিটি দাবি ভারতের তরফে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে ৷
সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে পাকিস্তানের কথা গোটা দুনিয়াকে জানাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে সাতটি সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে ভারত ৷ পহেলগাঁওয়ে হামলার কথা উল্লেখ করে তারা বিশ্বকে বলছেন, পাকিস্তান জঙ্গিদের সাহায্য করে ৷ নিজের মাটিতে হওয়া জঙ্গি হামলার জবাব দিতেই অপারেশন সিঁদুর করেছে ভারত ৷ আর নাশকতার প্রতিবাদেই সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করেছে দিল্লি ৷ ভারতের কূটনৈতিক সফরের কথা জানতে পেরে একই পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয় ইসলামাবাদও ৷ পাকিস্তানের প্রাক্তন বিদেশ মন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টোকেই সেই দলের প্রধান করা হয় ৷ বিলায়ল বলেন, "আমি আন্তর্জাতিক স্তরে পাকিস্তানের কথা তুলে ধরব ৷ শান্তি স্থাপনের আহ্বান করব ৷ "
অপারেশন সিঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ দুনিয়াকে পাকিস্তান বলবে না সেটা ভারত জানত ৷ তাই আগে থেকে প্রস্তুত ছিল দিল্লি ৷ সংঘাত থামার পর এখন ভারতের তরফে একাধিক প্রমাণ তুলে ধরা হচ্ছে ৷ পাকিস্তানের ঠিক কতটা ক্ষতি হয়েছে তা সবিস্তারে ব্যাখ্য়া করা হয়েছে ৷ যাঁরা এই সামরিক অভিযানের কৌশল তৈরির মতো কাজের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তাঁরাই হামলার বিভিন্ন ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আনছেন ৷ পাকিস্তান ভারতের সেনাঘাঁটিতে হামলা চালানোর কথা বলেছে ৷ আর ভারতের তরফে শীর্ষ সামরিক কর্তারা ঠিক সেই সমস্ত ঘাঁটিতে বসে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন ৷ সাংবাদিক বৈঠক করে এবং হামলার ভিডিয়ো শেয়ার করে পাকিস্তানের মিথ্যার মুখোশ খুলে দিয়েছে ভারতীয় সেনা ৷
সবমিলিয়ে বোঝাই যায় মিথ্যা কথা বলতে অভ্যস্ত পাকিস্তান, হারকে জয় বলে দেখাতে ব্যস্ত পাকিস্তান আবারও আন্তর্জাতিক মঞ্চে ধাক্কা খেয়েছে ৷ আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারত যেভাবে পাকিস্তানের মুখোশ খুলে দিয়েছে তার সামনে কোনও যুক্তিই তুলে ধরতে পারছে না তারা ৷ এখানে আসিফ মুনিরের কথা আলাদা করে না বললেই নয় ৷ নবনিযুক্ত ফিল্ড মার্শাল বোধহয় স্লিমের লেখা বইয়ের মানে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন ৷ তাঁর কাছে এই পদ পাওয়ার বিষয়টি অনেকটা 'পাক-বাহিনীর হারেই আমার জয় '-এর মতো দেখাচ্ছে ৷