ETV Bharat / opinion

ট্রাম্পের নীতির প্রভাব থেকে ভারতের আর্থিক বৈষম্য- বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর মুখোমুখি ইটিভি ভারত - KAUSHIK BASU

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু মনে করেন, ট্রাম্পের নীতিতে সমস্যায় পড়বে মার্কিন অর্থনীতি। উৎপাদনে জোর দিয়ে কর্মসংস্থানে জোয়ার না আনলে বিপদ বাড়বে ভারতেরও।

EMINENT ECONOMIST KAUSHIK BASU
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু (ইটিভি ভারত)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : April 1, 2025 at 6:24 PM IST

7 Min Read

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইনাড়ু'র অ্যাসোসিয়েট এডিটর এন বিশ্বপ্রসাদ

প্রশ্ন: ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতির ফলে বিশ্ব এবং ভারতের অর্থনীতি কীভাবে প্রভাবিত হতে পারে ?

কৌশিক বসু: ডোনাল্ড ট্রাম্পের আর্থিক নীতির সবচেয়ে কঠিন বিষয় হল এটিকে ব্যাখ্যা করা কার্যত অসম্ভব। তিনি বলেছেন, যে সমস্ত দেশ আমেরিকার থেকে বাড়তি হারে কর নেয় তিনিও তাদের সঙ্গে সেই একই কাজ করবেন। সম্প্রতি একটি নির্দেশিকা জারি করে তিনি জানান, আমেরিকায় যাঁরা অটোমোবাইলের যন্ত্রাংশ পাঠাবে তাদের এখন থেকে 25 শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে। এখানেই বলতে হয়, ট্রাম্পের কয়েকটি নীতিকে ব্যাখ্যা করা খুবই কঠিন। পারস্পরিক শুল্ক বা রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ কথাটির মানে কী ? একটি সামগ্রী একটি দেশ থেকে অন্য দেশে যায়। সেখানে তার উপর একাধিক কর আরোপিত হয়। কেউ যে জিনিস পাঠাচ্ছে সেটাই আবার পরে কিনছে - বিষয়টা মোটেই এমন নয়। তাহলে পারস্পরিক শুল্ক বিষয়টির মানে কী দাঁড়ায় ? মানে বোঝাই যায়, এখানে প্রবল অনিশ্চয়তা আছে। তার সঙ্গে ট্রাম্প সুরক্ষাবাদের আশ্রয় নিয়েছেন । মানে বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার থেকে আমেরিকার সংস্থাগুলিকে রক্ষা করার প্রয়াস করছেন । তাতে অর্থনীতির উপর কুপ্রভাব পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তবে আগামিদিনে এই ধরনের নীতির সবচেয়ে বেশি কুপ্রভাব পড়তে চলেছে মার্কিন অর্থনীতির উপর। দেশের সংস্থাগুলিকে অকারণ 'সুরক্ষা' দেওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে মার্কিন অর্থনীতিতে।

প্রশ্ন: নিজের দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে ট্রাম্প পারস্পরিক শুল্ক লাগু করেছেন। ভারতের মতো দেশ এর মোকাবিলা করবে কী করে ?

কৌশিক বসু: পারস্পরিক শুল্ক বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে সংশয় থাকায় ভারতের সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়েও ধোঁয়াশা ছিল। তবে যাই হোক না কেন, শুল্ক কমানোর ভাবনা ভালো। আর সেদিক থেকে দেখলে এটা ভারতের কাছে একটি ভালো সুযোগও বটে। 1990 সাল থেকে 1993 সাল পর্যন্ত ভারত শুল্ক কমানোর নীতি নিয়েছিল। তার দারুণ প্রভাব পড়েছিল অর্থনীতিতে। বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার ভরে উঠেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারত গত এক দশক ধরে পারস্পরিক শুল্ক বাড়িয়ে চলেছে । 2014 সালে 13 শতাংশ শুল্ক নিত ভারত। এখন তা বেড়ে হয়েছে 18 শতাংশ। সেদিক থেকে বিচার করলে ট্রাম্পের ভাবনা যাই হোক না কেন ভারতের এই সুযোগ কাজে লাগানো উচিত । কানাডা থেকে শুরু করে চিন এবং মেক্সিকো আগেই সে পথে হেঁটেছে।

প্রশ্ন: ওষুধের শুল্কও বাড়িয়েছেন ট্রাম্প। আমেরিকার নাগরিকদের উপরও কি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না ?

কৌশিক বসু: ওষুধের শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়া মোটেই ভালো উদ্যোগ নয়। এই সিদ্ধান্তে ভারত প্রভাবিত হবে না কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ওষুধ উৎপাদনের দিক থেকে আমাদের অবস্থান একেবারে প্রথম দিকে। তবে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত আমেরিকার নাগরিকদের অবশ্যই প্রভাবিত করবে। প্রভাবিত হবে তাঁদের ভালো থাকা । বিশেষ করে স্বাস্থ্য বিমা নেই এমন মানুষদের বাড়তি সমস্যার মুখে পডতে হবে ।

প্রশ্ন: বিদেশের কর্মী ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ আরোপের পথে হেঁটেছেন ট্রাম্প। আমেরিকার অর্থনীতিকে কি এই বিষয়টি সাহায্য করবে ?

কৌশিক বসু: আমি মনে করি এই সিদ্ধান্তের ফলে মার্কিন অর্থনীতির উপর কোনও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কারণ, অতীতে আমেরিকা বিদেশ থেকে আসা কর্মীদের দ্বারা বিরাট লাভবান হয়েছে। বিশেষ করে ভারতের মতো দেশ থেকে আসা দক্ষ কর্মীরা আমেরিকাকে নানাভাবে উন্নতি করতে সাহায্য করেছে। সাতের এবং আটের দশকে মনে করা হয়েছিল মাথা পিছু আয়ের নিরিখে আমেরিকাকে জাপান ছাপিয়ে যাবে। সেটা কখনও হয়নি। এক জায়গায় গিয়ে জাপান থেমে গিয়েছে। কিন্তু আমেরিকাকে কখনও পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এর অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে একটি হল বিদেশ থেকে আসা কর্মীদের পরিশ্রম।

প্রশ্ন: একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে আপনি গণতন্ত্র নিয়ে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। আপনি বলেছেন, "গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের উপর বিবিধ চাপ তৈরি হয়েছে। তার জেরে পৃথিবী আরও একবার সঙ্কটের মুখোমুখি। বৈষম্যের কারণে গণতন্ত্রের অভাবনীয় ক্ষতি হচ্ছে।" এটা সত্যি যে ভারতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। তার জেরে বৈষম্য বাড়ছে। ভারত কীভাবে এই ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে ?

কৌশিক বসু: গোটা দুনিয়ায় গণতন্ত্র কেন ক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা আলোচনার বিষয়। আমি মনে করি অর্থনৈতিক বৈষম্য এর অন্যতম কারণ। বিশেষ করে সোশাল মিডিয়ার যুগে বড় আকারের আর্থিক বৈষম্যের মানে শুধুই এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হওয়াকে বোঝায় না যেখানে সমাজের একটি গোষ্ঠীর ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে এবং অন্য পক্ষ গরিব থেকে যাবে। এই বৈষম্যের ফলে মানুষের চিন্তাভাবনার পরিসরও প্রভাবিত হয়। গরিবের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করে দেওয়ার নীরব প্রচেষ্টাও চলে । সমস্ত প্রয়োজনে তাঁদের কথা শোনার সুযোগ আমাদের হয় না। ভারতে বৈষম্য চোখে পড়ার মতো হারে বেড়েছে। বিশেষ করে যদি কতিপয় বিত্তবানের সঙ্গে সাধারণ মানুষের রোজগারের ফারাক দেখা হয় তাহলে দেখা যাবে এমন বৈষম্য ব্রিটিশ আমলের পর আর দেখা যায়নি। এই তীব্র বৈষম্য দূর করার উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত ভারতের।

প্রশ্ন: সিএসও ( সেন্ট্রাল স্ট্যাটিসটিক্স অফিস অফ ইন্ডিয়া) জানিয়েছে এবার ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার হতে পারে 6.5 শতাংশ। চার বছরের মধ্যে আর্থিক বৃদ্ধির হার কখনও এত কম হয়নি। এমন পরিস্থিতি কেন তৈরি হল বলে আপনি মনে করেন ?

কৌশিক বসু: সামগ্রিকভাবে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির পরিমাণ খারাপ নয়। তবে সমস্যা লুকিয়ে আছে গভীরে। এই ধরনের সমস্যা আমাদের অর্থনীতিকে দুর্বল করে । ভারতের সঞ্চয় এবং বিদেশ থেকে আসা বিনিয়োগের পরিমাণ কমতে শুরু করেছে 2012 সাল থেকে। দেশের যুবক-যুবতীর হাতে কাজ নেই । উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশ যতটা অগ্রসর হতে পারে তার ধারে কাছেও আমরা যেতে পারছি না। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের দিন কাটছে স্লোগান আর শিরোনাম নিয়ে । আমাদের পর্যাপ্ত তথ্য চাই । নির্দিষ্ট নীতি চাই। আমাদের দেশে প্রতিভার কোনও অভাব নেই। তবে সেই প্রতিভা আমরা কাজে লাগাতে পারি না। প্রতিফার সুফলও পাই না। আমার মনে হয় রাজনৈতিক দড়ি টানাটানি অর্থনীতির ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। প্রগতির জন্য যে কোনও সমাজে আস্থা এবং সহযোগিতার বাতাবরণ দরকার। সাম্প্রতিক কালে এখানেও পচন ধরেছে।

প্রশ্ন: বেকারত্ব এবং মোটা মাইনের চাকরি না থাকা ভারতের উন্নতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে । নীতির ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন আনলে পরিস্থিতি বদলাবে বলে আপনার মনে হয় ?

কৌশিক বসু: আমাদের পরিকল্পনা করে উৎপাদন ক্ষেত্রে জোয়ার আনতে হবে । চিনের শ্রমিকদের ভাতা বেড়েছে । সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেক উন্নয়নশীল দেশ নিজেদের রফতানির ক্ষেত্রে বড় সাফল্য পেয়েছে । ভারতে তেমন কিছু হয়নি। আমাদের শ্রম আইনে পরিবর্তন আনতে হবে। সংস্কার করতে হবে । তবে তা করতে হলে সেই ধরনের নীতি প্রণয়নের বিষয়ে মনযোগী হতে হবে আমাদের।

প্রশ্ন: ভারত 2047 সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে চায় । এখন অর্থনীতির বৃদ্ধি যা তাতে এই লক্ষ্য স্পর্শ করা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন ?

কৌশিক বসু: ভারতের পক্ষে 2047 সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়া সম্ভব। তবে এখন কাজকর্ম যেভাবে চলছে সেভাবে চললে হবে না । আমি আরও বলতে চাই, আজ থেকে 20 বা 30 বছর বাদে আমরা কোথায় গিয়ে পৌঁছব তা এখন থেকে ভাবা মানে, বর্তমান অর্থনীতিতে থাকা দুর্বলতা থেকে নজর সরিয়ে রাখা। উজ্জ্বল আগামীর দিকে তাকিয়ে সংবাদপত্রের পাতাজোড়া ঝকঝকে শিরোনামের কথা না ভেবে আমাদের উচিত বর্তমান সমস্যার দিকে মননিবেশ করা । আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার উৎপাদন শিল্পে জোর দেওয়া। তাহলে কর্মীর চাহিদা বাড়বে । সমাজে বাসা বাঁধা বৈষম্য কমবে। নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমাদের পেশদারি মানসিকতা আনতে হবে । একসময় এই কারণে গোটা দুনিয়ায় ভারতের প্রসিদ্ধি ছিল। এর পাশাপাশি বর্তমান এবং আগামী 2-3 বছরের পরিস্থিতির দিকে নজর রাখলে আমরা প্রভূত উন্নতি করতে পারব ।

কৌশিক বসু, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ভারত সরকারের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইনাড়ু'র অ্যাসোসিয়েট এডিটর এন বিশ্বপ্রসাদ

প্রশ্ন: ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতির ফলে বিশ্ব এবং ভারতের অর্থনীতি কীভাবে প্রভাবিত হতে পারে ?

কৌশিক বসু: ডোনাল্ড ট্রাম্পের আর্থিক নীতির সবচেয়ে কঠিন বিষয় হল এটিকে ব্যাখ্যা করা কার্যত অসম্ভব। তিনি বলেছেন, যে সমস্ত দেশ আমেরিকার থেকে বাড়তি হারে কর নেয় তিনিও তাদের সঙ্গে সেই একই কাজ করবেন। সম্প্রতি একটি নির্দেশিকা জারি করে তিনি জানান, আমেরিকায় যাঁরা অটোমোবাইলের যন্ত্রাংশ পাঠাবে তাদের এখন থেকে 25 শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে। এখানেই বলতে হয়, ট্রাম্পের কয়েকটি নীতিকে ব্যাখ্যা করা খুবই কঠিন। পারস্পরিক শুল্ক বা রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ কথাটির মানে কী ? একটি সামগ্রী একটি দেশ থেকে অন্য দেশে যায়। সেখানে তার উপর একাধিক কর আরোপিত হয়। কেউ যে জিনিস পাঠাচ্ছে সেটাই আবার পরে কিনছে - বিষয়টা মোটেই এমন নয়। তাহলে পারস্পরিক শুল্ক বিষয়টির মানে কী দাঁড়ায় ? মানে বোঝাই যায়, এখানে প্রবল অনিশ্চয়তা আছে। তার সঙ্গে ট্রাম্প সুরক্ষাবাদের আশ্রয় নিয়েছেন । মানে বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার থেকে আমেরিকার সংস্থাগুলিকে রক্ষা করার প্রয়াস করছেন । তাতে অর্থনীতির উপর কুপ্রভাব পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তবে আগামিদিনে এই ধরনের নীতির সবচেয়ে বেশি কুপ্রভাব পড়তে চলেছে মার্কিন অর্থনীতির উপর। দেশের সংস্থাগুলিকে অকারণ 'সুরক্ষা' দেওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে মার্কিন অর্থনীতিতে।

প্রশ্ন: নিজের দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে ট্রাম্প পারস্পরিক শুল্ক লাগু করেছেন। ভারতের মতো দেশ এর মোকাবিলা করবে কী করে ?

কৌশিক বসু: পারস্পরিক শুল্ক বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে সংশয় থাকায় ভারতের সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়েও ধোঁয়াশা ছিল। তবে যাই হোক না কেন, শুল্ক কমানোর ভাবনা ভালো। আর সেদিক থেকে দেখলে এটা ভারতের কাছে একটি ভালো সুযোগও বটে। 1990 সাল থেকে 1993 সাল পর্যন্ত ভারত শুল্ক কমানোর নীতি নিয়েছিল। তার দারুণ প্রভাব পড়েছিল অর্থনীতিতে। বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার ভরে উঠেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারত গত এক দশক ধরে পারস্পরিক শুল্ক বাড়িয়ে চলেছে । 2014 সালে 13 শতাংশ শুল্ক নিত ভারত। এখন তা বেড়ে হয়েছে 18 শতাংশ। সেদিক থেকে বিচার করলে ট্রাম্পের ভাবনা যাই হোক না কেন ভারতের এই সুযোগ কাজে লাগানো উচিত । কানাডা থেকে শুরু করে চিন এবং মেক্সিকো আগেই সে পথে হেঁটেছে।

প্রশ্ন: ওষুধের শুল্কও বাড়িয়েছেন ট্রাম্প। আমেরিকার নাগরিকদের উপরও কি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না ?

কৌশিক বসু: ওষুধের শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়া মোটেই ভালো উদ্যোগ নয়। এই সিদ্ধান্তে ভারত প্রভাবিত হবে না কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ওষুধ উৎপাদনের দিক থেকে আমাদের অবস্থান একেবারে প্রথম দিকে। তবে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত আমেরিকার নাগরিকদের অবশ্যই প্রভাবিত করবে। প্রভাবিত হবে তাঁদের ভালো থাকা । বিশেষ করে স্বাস্থ্য বিমা নেই এমন মানুষদের বাড়তি সমস্যার মুখে পডতে হবে ।

প্রশ্ন: বিদেশের কর্মী ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ আরোপের পথে হেঁটেছেন ট্রাম্প। আমেরিকার অর্থনীতিকে কি এই বিষয়টি সাহায্য করবে ?

কৌশিক বসু: আমি মনে করি এই সিদ্ধান্তের ফলে মার্কিন অর্থনীতির উপর কোনও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কারণ, অতীতে আমেরিকা বিদেশ থেকে আসা কর্মীদের দ্বারা বিরাট লাভবান হয়েছে। বিশেষ করে ভারতের মতো দেশ থেকে আসা দক্ষ কর্মীরা আমেরিকাকে নানাভাবে উন্নতি করতে সাহায্য করেছে। সাতের এবং আটের দশকে মনে করা হয়েছিল মাথা পিছু আয়ের নিরিখে আমেরিকাকে জাপান ছাপিয়ে যাবে। সেটা কখনও হয়নি। এক জায়গায় গিয়ে জাপান থেমে গিয়েছে। কিন্তু আমেরিকাকে কখনও পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এর অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে একটি হল বিদেশ থেকে আসা কর্মীদের পরিশ্রম।

প্রশ্ন: একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে আপনি গণতন্ত্র নিয়ে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। আপনি বলেছেন, "গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের উপর বিবিধ চাপ তৈরি হয়েছে। তার জেরে পৃথিবী আরও একবার সঙ্কটের মুখোমুখি। বৈষম্যের কারণে গণতন্ত্রের অভাবনীয় ক্ষতি হচ্ছে।" এটা সত্যি যে ভারতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। তার জেরে বৈষম্য বাড়ছে। ভারত কীভাবে এই ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে ?

কৌশিক বসু: গোটা দুনিয়ায় গণতন্ত্র কেন ক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা আলোচনার বিষয়। আমি মনে করি অর্থনৈতিক বৈষম্য এর অন্যতম কারণ। বিশেষ করে সোশাল মিডিয়ার যুগে বড় আকারের আর্থিক বৈষম্যের মানে শুধুই এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হওয়াকে বোঝায় না যেখানে সমাজের একটি গোষ্ঠীর ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে এবং অন্য পক্ষ গরিব থেকে যাবে। এই বৈষম্যের ফলে মানুষের চিন্তাভাবনার পরিসরও প্রভাবিত হয়। গরিবের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করে দেওয়ার নীরব প্রচেষ্টাও চলে । সমস্ত প্রয়োজনে তাঁদের কথা শোনার সুযোগ আমাদের হয় না। ভারতে বৈষম্য চোখে পড়ার মতো হারে বেড়েছে। বিশেষ করে যদি কতিপয় বিত্তবানের সঙ্গে সাধারণ মানুষের রোজগারের ফারাক দেখা হয় তাহলে দেখা যাবে এমন বৈষম্য ব্রিটিশ আমলের পর আর দেখা যায়নি। এই তীব্র বৈষম্য দূর করার উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত ভারতের।

প্রশ্ন: সিএসও ( সেন্ট্রাল স্ট্যাটিসটিক্স অফিস অফ ইন্ডিয়া) জানিয়েছে এবার ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার হতে পারে 6.5 শতাংশ। চার বছরের মধ্যে আর্থিক বৃদ্ধির হার কখনও এত কম হয়নি। এমন পরিস্থিতি কেন তৈরি হল বলে আপনি মনে করেন ?

কৌশিক বসু: সামগ্রিকভাবে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির পরিমাণ খারাপ নয়। তবে সমস্যা লুকিয়ে আছে গভীরে। এই ধরনের সমস্যা আমাদের অর্থনীতিকে দুর্বল করে । ভারতের সঞ্চয় এবং বিদেশ থেকে আসা বিনিয়োগের পরিমাণ কমতে শুরু করেছে 2012 সাল থেকে। দেশের যুবক-যুবতীর হাতে কাজ নেই । উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশ যতটা অগ্রসর হতে পারে তার ধারে কাছেও আমরা যেতে পারছি না। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের দিন কাটছে স্লোগান আর শিরোনাম নিয়ে । আমাদের পর্যাপ্ত তথ্য চাই । নির্দিষ্ট নীতি চাই। আমাদের দেশে প্রতিভার কোনও অভাব নেই। তবে সেই প্রতিভা আমরা কাজে লাগাতে পারি না। প্রতিফার সুফলও পাই না। আমার মনে হয় রাজনৈতিক দড়ি টানাটানি অর্থনীতির ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। প্রগতির জন্য যে কোনও সমাজে আস্থা এবং সহযোগিতার বাতাবরণ দরকার। সাম্প্রতিক কালে এখানেও পচন ধরেছে।

প্রশ্ন: বেকারত্ব এবং মোটা মাইনের চাকরি না থাকা ভারতের উন্নতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে । নীতির ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন আনলে পরিস্থিতি বদলাবে বলে আপনার মনে হয় ?

কৌশিক বসু: আমাদের পরিকল্পনা করে উৎপাদন ক্ষেত্রে জোয়ার আনতে হবে । চিনের শ্রমিকদের ভাতা বেড়েছে । সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেক উন্নয়নশীল দেশ নিজেদের রফতানির ক্ষেত্রে বড় সাফল্য পেয়েছে । ভারতে তেমন কিছু হয়নি। আমাদের শ্রম আইনে পরিবর্তন আনতে হবে। সংস্কার করতে হবে । তবে তা করতে হলে সেই ধরনের নীতি প্রণয়নের বিষয়ে মনযোগী হতে হবে আমাদের।

প্রশ্ন: ভারত 2047 সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে চায় । এখন অর্থনীতির বৃদ্ধি যা তাতে এই লক্ষ্য স্পর্শ করা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন ?

কৌশিক বসু: ভারতের পক্ষে 2047 সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়া সম্ভব। তবে এখন কাজকর্ম যেভাবে চলছে সেভাবে চললে হবে না । আমি আরও বলতে চাই, আজ থেকে 20 বা 30 বছর বাদে আমরা কোথায় গিয়ে পৌঁছব তা এখন থেকে ভাবা মানে, বর্তমান অর্থনীতিতে থাকা দুর্বলতা থেকে নজর সরিয়ে রাখা। উজ্জ্বল আগামীর দিকে তাকিয়ে সংবাদপত্রের পাতাজোড়া ঝকঝকে শিরোনামের কথা না ভেবে আমাদের উচিত বর্তমান সমস্যার দিকে মননিবেশ করা । আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার উৎপাদন শিল্পে জোর দেওয়া। তাহলে কর্মীর চাহিদা বাড়বে । সমাজে বাসা বাঁধা বৈষম্য কমবে। নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমাদের পেশদারি মানসিকতা আনতে হবে । একসময় এই কারণে গোটা দুনিয়ায় ভারতের প্রসিদ্ধি ছিল। এর পাশাপাশি বর্তমান এবং আগামী 2-3 বছরের পরিস্থিতির দিকে নজর রাখলে আমরা প্রভূত উন্নতি করতে পারব ।

কৌশিক বসু, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ভারত সরকারের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.