পারমিতা কামিলা
হায়দরাবাদ, 21 জুন: বিশ্বজুড়ে সঙ্গীত প্রচারের জন্য প্রতি বছর 21 জুন বিশ্ব সঙ্গীত দিবস (World Music Day 2025) পালন করা হয় ৷ যা 'ফেতে দে লা মিউজিক' (Faites de la musique) নামেও পরিচিত ৷ যার মানে 'মেক 'মিউজিক ৷ গানে গানে জীবন উদযাপন করাটাই যেন এই বিশেষ দিনের মূল উদ্দেশ্য ৷
জুন মাস সঙ্গীত প্রেমীদের কাছে আরও একটা কারণে ভীষণ কাছের ৷ তা হল 16 জুন লেজেন্ডারি সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন ৷ যাঁর গানের সমুদ্রে আজও ডুব দেন আপামর সঙ্গীতপ্রেমীরা ৷ 1989 সালের 26 সেপ্টেম্বর তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন ৷ তবে বিশ্ববাসীর জন্য রেখে গিয়েছেন গানে ভরা অমূল্য সম্পদ ৷ আজ বিশেষ দিনে ইটিভি ভারতের সঙ্গে এমন এক শিল্পী আড্ডা দিয়েছেন যাঁর কণ্ঠে যেন স্বয়ং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের (Hemanta Mukhopadhyay) বাস ৷ তিনি সাগ্নিক সেন (Sagnik Sen) ৷ একান্ত আড্ডার সুরেলা সফরে উঠে এসেছে কীভাবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায় মুগ্ধ হয়েছিলেন যুবক সাগ্নিকের গান শুনে ৷ কীভাবে নির্দিষ্ট একটা স্টাইল-ঘরানা ধরে রেখে আলাদা পরিচিতি তৈরি করেছেন, একান্ত আড্ডায় মন খুলে কথা বললেন সাগ্নিক ৷

ইটিভি ভারত- গলায় যেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাস, গানের জগতে কীভাবে জার্নি শুরু ?
সাগ্নিক- বাড়িতে ভীষণভাবে গান বাজনার চর্চা ছিল ৷ আমার বাবা প্রয়াত স্বপন সেন ও মা আভা সেনকে দেখেছি ছোট থেকেই গান নিয়ে চর্চা করতে ৷ বাবা খুব ভালো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান গাইতে পারতেন ৷ সেই সময় বাংলা সিনেমায় প্লে-ব্যাকও করেছেন ৷ অনেক অনুষ্ঠানেও গান করেছেন বাবা ৷ কিন্তু সেইভাবে পেশাগতভাবে এগোননি ৷ আমি জন্মানোর পর থেকেই কথা বলার আগে থেকে গান শুনেছি বেশি ৷ বাবা নানা শিল্পীর গানই শুনতেন ৷ তবে আমার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান ছোট থেকেই ভীষণ ভালো লাগত ৷ ওঁনার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ছেলেবেলা থেকেই ৷ কীভাবে এসেছে, কেন এসেছে এর ব্যাখ্যা করা মুশকিল ৷
ইটিভি ভারত- গানের তালিম কার কাছ থেকে নেওয়া ?
সাগ্নিক- আমাকে একবার গানের স্কুলে তালিমের জন্য ভর্তি করা হয়েছিল ৷ ঘরে বাবাই গান শেখাতেন ৷ মা চেয়েছিলেন আরও ভালো করে শেখাতে ৷ গানের স্কুলে যখন খাতায় সরগম-সহ আরও অনেক কিছু লিখে দিলো তা দেখে আমি পালিয়ে এসেছিলাম ৷ আমার গান ভালো লাগে, তাই গাই ৷ আমি প্রথাগত গানের শিক্ষা বা রেওয়াজ কোনটার মধ্য দিয়ে যাইনি ৷
ইটিভি ভারত- কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড়াশোনা কিন্তু মিউজিককে বেছে নেওয়া কীভাবে ?
সাগ্নিক- হ্যাঁ, এই বিষয়ে পড়াশোনা করতে করতে আমাকে মাঝ পথে ছেড়ে দিতে হয়েছে ৷ কারণ সেই সময় আমার বাবা প্রয়াত হন ৷ পারিবারিক ব্যবসা দেখার কাজে আমাকে ঢুকে যেতে হল ৷ প্রায় 8 বছর পর আমি ফের গানের জগতে ফিরি ৷ 2014 সালে পেশাগত ভাবে গান শুরু করি ৷ তার আগে এইচএমভি সারেগামা, হিন্দুস্তান রেকর্ডস, প্রাইম মিউজিক থেকে টুকটাক গান বেরিয়েছিল ৷ রবীন্দ্র সঙ্গীতের অ্যালবামও বের করেছিলাম ৷
ইটিভি ভারত- 8 বছরের গ্যাপ, গানের জগতে ফিরতে কোনও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল ?
সাগ্নিক- আমার সঙ্গীত শিক্ষার দিক থেকে গুরু বলতে বাবা ৷ আর অবশ্যই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ৷ কারণ তাঁকে চোখের সামনে পাইনি কিন্তু তাঁর গান শুনেই বড় হওয়া ৷ ব্যবসা করতে করতে বেশ কিছু গানের জায়গা, টিভি চ্যানেলে যোগাযোগ করেছিলাম একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য ৷ কিন্তু সকলেই আমাকে বলেছিল, 'না..না.. আপনার গলা চলবে না ৷ এই সব গান কেউ শুনবে না ৷' কিন্তু সেই কথা শুনে আমি ভেঙে পড়িনি ৷ নিজের পথও পরিবর্তন করিনি ৷ আসলে রবীন্দ্র সঙ্গীত বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, কিশোর কুমারের গান কোনও যুগ মানে না ৷ এগুলো অমর সৃষ্টি, এভারগ্রিন ৷ ফলে সময়ের সঙ্গে কোন গান চলছে সেই মেনে আমি চলার পক্ষপাতী ছিলাম না ৷ আমি এই সকল শিল্পীদের গানে-সৃষ্টিতে নিজের আবেগ-ভালোবাসা ধরে রাখতে চেয়েছি ৷
ইটিভি ভারত- পরিচিতি কীভাবে তৈরি হল মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে ?
সাগ্নিক- একটা টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য সঙ্গীত পরিচালক দেবজিৎ রায় আমাকে দিয়ে একটা প্রোগ্রাম করান ৷ যেদিন সেই অনুষ্ঠান টেলিকাস্ট হয়েছে তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত কাজের অভাব হয়নি ৷
ইটিভি ভারত- রিয়েলিটি শো শিল্পীদের জন্য বড় প্ল্যাটফর্ম, সেই সুযোগ কেন নেননি ?
সাগ্নিক- আমার রিয়েলিটি শো কোনওদিনই পছন্দ ছিল না ৷ আসলে রিয়েলিটি শোকে কখনই রিয়েল মনে হয়নি ৷ খুবই ফেক মনে হয়েছে ৷ সত্যি কথা বলতে, ওখানে দশজনের গান বা দশ রকমের গান করতে বলবে ৷ কিন্তু আমি শুরু থেকেই আমার গানের ধরন বা জঁনার ঠিকই করে রেখেছিলাম ৷ রবীন্দ্র সঙ্গীত (Rabindra Sangeet), হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের (Hemanta Mukherjee) গান আর আমার নিজের গান, ব্যস এর বাইরে আমি কোনও দিনও যাব না ৷ তাতে আমার একটা টাকাও যদি রোজগার না হলে না হবে কিন্তু গানের দিক থেকে আমি কম্প্রোমাইজ করব না ৷ তাই নিয়েই আছি আর তাই নিয়েই থাকব ৷

ইটিভি ভারত- হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় কীভাবে ? আপনার গান শুনে তিনি নাকি চমকে গিয়েছিলেন ?
সাগ্নিক- আমি বেলা মুখোপাধ্যায়কে ( Bela Mukhopadhyay) জেঠিমা বলে ডাকতাম ৷ আমি ছবি আঁকতে ভালোবাসি ৷ সেই ছবি দেখে জেঠিমার খুব ভালো লেগেছিল ৷ আমি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা পোট্রেট জেঠিমাকে দিয়েছিলাম ৷ ওই দেখে ভীষণ পছন্দ হয়েছিল ৷ ওনাদের বাড়িতে সকলেই জানতেন আমি ভালো ছবি আঁকি ৷ কিন্তু জানতেন না আমি গানও করি ৷ জেঠিমা কোনওভাবে জানতে পেরেছিল ৷

একদিন গল্পের ছলে আমাকে বলেন, "একটা গান শোনা তো ৷" আমি বললাম, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কোন গানাব শোনাব বলুন ৷ জেঠিমা বলেন, "বারবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলবি না ৷ আমায় যখন জেঠিমা বলছিস ওঁনাকে জ্যাঠা বলে সম্বোধন করবি ৷" আমি তখন জেঠিমাকে শুনিয়েছিলাম, 'ডাগর ডাগর চোখে কেন কাজল দিলে...' ৷ গান শুনে জেঠিমা বলেন, "বাবা ! তুই তো হেমন্ত জেঠুকে জলের মধ্যে চিনি দিয়ে সরবত বানিয়ে ঢকঢক করে পুরো গিলে নিয়েছিস ৷" এটাই ছিল প্রথম প্রতিক্রিয়া ৷ এরপর আমাকে ক্যাসেটে আমার কিছু গান রেকর্ড করে দিতে বলেছিলেন ওনাকে ৷ সেটাও একটা মজার ঘটনা ৷
জেঠিমা মাথার কাছে টেপ রেকর্ডার নিয়ে শুতেন ৷ একদিন আমার কিছু গান রেকর্ড করে টেপের মধ্যে দিই ৷ তখন তার মধ্যে হেমন্ত জেঠুরও গানের একটা ক্যাসেট ছিল ৷ আমি সেটা বের করে নিজের করা গানের ক্যাসেট চালাই ৷ জেঠিমা একটা গান শুনতে শুনতে তাঁর সেক্রেটারিকে বললেন, "আরে, সাগ্নিকের গানটা চালাও ৷" তখন তাঁর সেক্রেটারি জানান, সেটা আমার গানই চলছে ৷ শুনে চমকে গিয়েছিলেন ৷
ইটিভি ভারত- 'মনিকা ও মাই ডার্লিং' সিনেমা দিয়ে বলিউডে আত্মপ্রকাশ ৷ আগামী আর কোন প্রজেক্ট রয়েছে হাতে ?
সাগ্নিক- 'মনিকা ও মাই ডার্লিং' (Monica, O My Darling) সিনেমার মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন অচিন্ত ঠক্কর ৷ ওনারা সোশাল মাধ্যমে নানাভাবে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন ৷ আমি দেখে কথা বলি ৷ ওনারা জানান, একটা গান আছে রাজকুমার রাওকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ৷ ছবির নাম তখনও জানতাম না ৷ সিনেমার পরিচালক বসন্ত বালা চেয়েছেন আমিই যেন এই গানের প্লে ব্যাক করি ৷ এই গান আমার পরিচিতি দেশের পাশাপাশি বিদেশের মাটিতে তৈরি করেছে ৷
পাশাপাশি পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীর (Vivek Agnihotri) একটা সিনেমায় আমার গান আছে ৷ তবে এখন এই বিষয়ে খুব বেশি কিছু বলা যাবে না ৷ করণ জোহরের (Karan Johar) ওয়েব সিরিজে গানের সুযোগ পেয়েছি ৷
ইটিভি ভারত- গানের ধারা বদলাছে ৷ ট্রেন্ড বদলাছে ৷ আপনি কখনও গানের স্টাইল পরিবর্তন করার কথা ভেবেছেন ?
সাগ্নিক- এখন সফট মেলোডি বা ভালো গান শোনার দর্শক কমে যাচ্ছে ৷ গান বাজনা মানে এখন রিদিম, নাচ, বিট, পা নাচবে যত এমন গান লোকে বেশি শুনছে ৷ তার মধ্যেও এমন কিছু শ্রোতা রয়েছেন যারা আজও মেলোডি গান, পুরনো গান শুনতে ভালোবাসেন ৷ তাদের জন্যই গান গেয়ে যাই ৷
আর আমি নিজের স্টাইল পরিবর্তন করতে চাই না ৷ হয়তো দেখা যাবে অন্য কোনও গান করতে গেলে আমি আমার একশ শতাংশ দিতে পারলাম না ৷ গানের সঙ্গে একাত্মবোধ করতে না পারলে মুশকিল ৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান আমার ভিতর থেকে আসে ৷ ফলে ওটা নিয়ে ভাবতেই হয় না ৷
ইটিভি ভারত- গানের জগতে 12 বছরের বেশি হয়ে গেল ৷ তথাকথিত প্রতিষ্ঠা পাওয়া এই শব্দের সঙ্গে সাগ্নিক কী এখনও লড়াই চালাচ্ছেন ?
সাগ্নিক- আমি এগুলো নিয়ে কখনও মাথাই ঘামাইনি ৷ আমি যেটুকু পারি, সৃষ্টিকর্তা যতটুকু দিয়েছেন তাই দিয়েই নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করে যাব ৷ ইন্ডাস্ট্রিতে গিয়ে কাজ চাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় ৷ খারাপ-ভালো সবকিছুতেই আছে ৷ এসব ভাবতে গেলে এর শেষ হবে না ৷ আর সত্যি কথা বলতে, আমার আলাদা করে টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠা পেতে হবে তেমন কোনও ইচ্ছাও ছিল না ৷
এখন সোশাল মিডিয়ার দৌলতে অনেক বেশি দর্শকের কাছে গান পৌঁছে যাচ্ছে ৷ ফলে কোনও সিনেমায় গান গাওয়ার থেকে নিজের গান সোশাল মিডিয়ায় দিলে তার রিচ অনেক বেশি ৷ বরং এখন একজন শিল্পী সিনেমায় গান গেয়ে যা রোজগার করতে পারে না, সোশাল মিডিয়ায় যারা রয়েছেন তারা অনেক বেশি আয় করছেন ৷ ফলে টিপিক্যাল প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হতে পারলাম কি না, সে নিয়ে ভাবনা নেই আমার ৷
ইটিভি ভারত- এখন সোশাল মিডিয়ায় সবাই সেলিব্রিটি ৷ সকলেই গায়ক-নায়ক ৷ শিল্পীর নজর দিয়ে এটাকে কীভাবে দেখেন ?
সাগ্নিক- আসলে যেটা ভালো সেটা থাকবে ৷ যেটার স্থায়ীত্ব পাওয়ার নয় সেটা মানুষ প্রথম দিকে গ্রহণ করলেও পরে মনে রাখবে না ৷ সেকাল-একাল বাদ দিয়ে আরও একটা কাল আছে সেটা হল চিরকাল ৷ ফলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, মহম্মদ রফি এই সকল শিল্পীর গান থেকে যাবে চিরকাল ৷ বাকিরা আসবে-যাবে ৷ কাউকে মানুষ মনে রাখবে আবার কাউকে ভুলে যাবে ৷
এখন রবীন্দ্র সঙ্গীতেও মিউজিক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা হয় ৷ কিন্তু এই গানে সেই স্টেকচার নেই যেখানে রকস বা ড্রাম বাজবে ৷ জোর করে কোনও কিছু করে লাভ হয় না ৷ যে গানের সঙ্গে যেটা যায়, মানায় সেইভাবেই রাখা উচিত ৷ জোর করে করলে দুদিনের জন্য ভাইরাল হবে তারপর হারিয়ে যাবে ৷
আর এখনকার জেনারেশনের গান শোনার টাইমও নেই ৷ এখন ইউটিউবে 2-3 মিনিটের গানের থেকে শর্টস দেখতে মানুষ বেশি পছন্দ করছেন ৷ কারণ সেটা 1 মিনিট বা 45 সেকেন্ডের হয় ৷ ফোনে ঝটপট দেখা হয়ে যায় ৷ সময় কমে যাচ্ছে তার সঙ্গে কমছে ধৈর্য্য ৷ বসে একটা গান 2-3 মিনিট শোনার মতো সময় এখন অনেকেই দেয় না ৷ কিছুদিন পর না শর্টস 5 সেকেন্ডে দাঁড়ায় ৷ আবার এর উল্টোটা হতে পারে ৷ হয়তো মানুষ ব্যস্ত জীবন থেকে বেরিয়ে একটু শান্তির খোঁজে গানটাকেই বেছে নিতে পারে ৷ কিছুই বলা সম্ভব নয় এখনকার দিনে ৷