ETV Bharat / entertainment

বাড়ি তৈরির স্বপ্ন অধরা ! সাদা ক্যানভাসেই কল্পনা সাজান এই কার্টুনিস্ট - CARTOONIST

কার্টুন শিল্পীর কথায়, "মানুষ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে ৷ সবকিছু তাড়াতাড়ি চায় ৷ দু'দিন বাদে হয়ত কার্টুনিস্ট হিসাবে কাজই পাব না ৷"

Etv Bharat
কার্টুন শিল্প (ইটিভি ভারত)
author img

By ETV Bharat Entertainment Team

Published : June 3, 2025 at 2:43 PM IST

7 Min Read

হায়দরাবাদ, 3 জুন: প্রায় একমাস হতে চলল বিশ্বজুড়ে পালিত হয়েছে ওয়ার্ল্ড কার্টুনিস্ট ডে (world cartoonist day) ৷ কার্টুন বললেই মনে পড়ে যায় বাঙালি কার্টুন শিল্পী নারায়ণ দেবনাথ, শৈলনারায়ণ চক্রবর্তী-র মতো ব্যক্তিত্বদের নাম ৷ ছোটবেলায় 'নন্টে ফন্টে' বা 'শক্তিমান' বই ছোটদের অন্যতম আকর্ষণের বিষয় ছিল ৷ সময় পাল্টাচ্ছে ৷ এখন সবকিছুই ডিজিটাল ৷ কিন্তু তারমধ্যেই 81 বছর বয়সী শিল্পী অমর লাহা নিজের ছন্দে তৈরি করে চলেছেন একের পর এক কার্টুন চরিত্র ৷

কম্পিউটারের 'ক' জানেন না তিনি ৷ নেই আঁকার প্রথাগত শিক্ষাও ৷ বাঙালি ব্যঙ্গচিত্রী ও লেখক চণ্ডী লাহিড়ীর আঁকা দেখে হয়েছেন অনুপ্রাণিত ৷ বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি অ্যানিমেশন কোম্পানিতে চিত্রশিল্পী, ইলাসট্রেটর, কার্টুন শিল্পী হিসাবে কাজ করেন ৷ নামমাত্র পারিশ্রমিক হলেও ছোট থেকেই 'হাফ সিরিয়াস' প্রবীণ এই ব্যক্তি জীবনের আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন মজাদার আঁকাতেই ৷ তিনি বলেন, "আমি এমনই ছবি আঁকতাম ৷ কার্টুন আঁকতে মজা লাগত ৷ ভালো লাগে ৷ খুবই অভাবের সংসার ছিল ৷ হাল ধরতে 25-26 বছর বয়সে শঙ্কর ঘোষ লেনে একটা দোকানে কাজে লেগে পড়ি ৷"

Bengal cartoonist-amar-laha
শিক্ষার আলো (ইটিভি ভারত)

শিল্পী অমর বাবু কোথাও কাজ করে সুখ পাচ্ছিলেন না ৷ হাতের কাছে সাদা কাগজ-পেন্সিল পেলেই ক্যানভাসে উজাড় করতেন এক আকাশ কল্পনা ৷ প্রথম দিকে থাকতেন কলকাতার ঠনঠনিয়া কালিবাড়ির কাছে ৷ তারপর সেখান থেকে টালিগঞ্জের কুঁদঘাটে চলে আসেন ৷ ততদিনে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবরকম কাজ করে ফেলেছেন ৷ এরমধ্যেই একদিন ভাগ্য সদয় হয় ৷ 2010 সালে কলকাতার অন্যতম বেসরকারি অ্যানিমেশন কোম্পানির কর্ণধার সুব্রত রায়ের নজরে পড়েন শিল্পী অমর ৷ শিল্পীর কথায়, "রাস্তা থেকে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন ৷ তিনি আমাকে প্রথম আঁকা নিয়ে কাজের সুযোগ দেন ৷ কার্টুনের চরিত্র আঁকা, ইলাস্ট্রেশন করা সেই সব প্রফেশনালি শুরু করি ৷"

এখন সবকিছু এআই নির্ভর ৷ কার্টুনিস্টের জীবিকা কতটা বিপদের মুখে ? অমর লাহার জবাব, "খুবই বিপদের মধ্যে রয়েছে ৷ কম্পিউটারে একটা কার্টুন আঁকতে বেশি সময় লাগে না ৷ কিন্তু সাদা পাতায়, পেন্সিল দিয়ে সেই চরিত্র কল্পনা করে আঁকাটা সময় সাপেক্ষ বিষয় ৷ ভাবনা চিন্তা থাকে ৷ মানুষ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে ৷ সবকিছু তাড়াতাড়ি চায় ৷ দু'দিন বাদে হয়ত কার্টুনিস্ট হিসাবে কাজই পাব না ৷"

Bengal cartoonist-amar-laha
হাসছি মোরা হাসছি দেখো... (ইটিভি ভারত)

তাঁর কথায়, 'নন্টে ফন্টে'র মতো কার্টুন দেখে ছোটবেলা কেটেছে ৷ একটা কার্টুন আঁকার আগে তার চরিত্র নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে হয় ৷ তারপর এক-দুদিন লেগে যায় কার্টুনের মতো আঁকতে ৷ যারা এআই-এর সাহায্যে চরিত্র তৈরি করে তাঁদের ওপর অতিরিক্ত একটা প্রেশার থাকেই ৷ যেমন একজন ডাকাতের চরিত্র কেমন হবে তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে হয় ৷ যদি মধ্যবয়সী ডাকাত হয় তা কেমন দেখতে হবে সেই নিয়েও কল্পনা করতে হয় ৷ তারপর আসে আঁকা ৷

পরিবার বলতে অমর বাবুর দুই মেয়ে ও এক স্ত্রী আছেন ৷ দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ৷ তাঁরাও আজ সাবলম্বী ৷ অমর বাবুর কথায়, পরিবারের একমাত্র রোজগেরে বলতে তিনিই ছিলেন ৷ কঠিন সময় পেরিয়েছেন ৷ অল্প আয়ে দাঁতে দাঁত চেপে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন ৷ কিন্তু রসবোধ কমেনি এতটুকু ৷ শিল্পীর কথায়, "আমার কার্টুনের রসিকতা ভালো লাগে ৷ আমি খুব গম্ভীর লোক নই ৷ মজা করতে ভালোবাসি ৷ সেটাই আঁকার মধ্যে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি ৷ সেটাই আমার জিয়নকাঠি ৷ আমার মাথায় থাকে যে আঁকা দেখে লোক মজা পাবে ৷ আমি বাস্তবেও ছোট থেকেই মজা করতে ভালোবাসি ৷ আমার বাড়িতে সিরিয়াজ কাজ কেউ দেয় না ৷ খরচার খাতায় ধরে রাখে ৷"

Bengal cartoonist-amar-laha
বীর বাহাদুর (ইটিভি ভারত)

মজার ছলে অমর বাবু বলেন, "একদিন আমার স্ত্রী বাজার থেকে বাটা মাছ আনতে বলেছিল ৷ আমি মজার ছলে বলে ফেলেছিলাম, বাটা না পেলে শ্রীলেদার্স বা অন্য কিছু আনলে চলবে ? স্ত্রী রেগে গিয়ে বাজারের ব্যাগ কেড়ে নিয়েছিল ৷ তারপর বাজারের পয়সা ফেরত চেয়েছিল ৷" এহেন মানুষ নাকি শ্রাদ্ধ বাড়িতেও যেতে ভয় পেতেন ৷ পাছে কোনও হাসির কথা বলে ফেলেন ৷ যে কারণে নিজের জ্যাঠামশাইয়ের মৃত্যুর সময়েও তিনি পরিবারের সামনে যাননি ৷ কখন কোন কথায় কী বলে ফেলবেন, সেই নিয়ে তিনি নিজেও প্রচন্ড ভয়ে ছিলেন ৷

স্কুল ফাইনাল পাশ করেননি ৷ অভাবের সংসারে বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন কাজের ধান্দায় ঘুরতে হবে ৷ সেই থেকে হাতের কাছে যা পেয়েছেন একটার পর একটা কাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন ৷ কিন্তু মন বসাতে পারছিলেন না ৷ শিল্পী বলেন, "শিল্পী চণ্ডী লাহিড়ীর একটা আঁকা খুব পছন্দ হয়েছিল ৷ দেখে মনে হয়েছিল এতে আনন্দ আছে ৷ আমার প্রথম আঁকা 'ছেলেবেলা' ম্যাগাজিনে-র গল্পতে বেরিয়েছিল ৷ তখনই প্রথম সুযোগ পাই ৷ দাতব্য চিকিৎসালয়ের মতো এঁকে দিতাম সকলকে ৷ এক জুতো কোম্পানির হয়ে এঁকে প্রথম 14 আনা আয় করেছিলাম ৷ সালটা তখন 68-70 হবে ৷"

Bengal cartoonist-amar-laha
দোলনায় আস্ত কঙ্কাল (ইটিভি ভারত)
কথাতেই বলে, যে কাজে ভালোবাসা আছে সেই কাজ করে শান্তি পাওয়া যায় ৷ কিন্তু অর্থের প্রয়োজন কি মেটে ? সবার স্বপ্ন কি সত্যি হয় ? অমর লাহার কথায়, "স্যার দয়া করে রেখেছেন তাই আছি ৷ মাসিক বেতন এখনও 20 হাজারও পেরোয়নি ৷ আমি কাজে ব্যস্ত থাকতে চাই ৷ তাতে যদি কম টাকা হয় চলবে ৷ আমি চাইতে পারব না ৷ একার কাঁধে সংসার ৷ এই চাকরি ছেড়ে নতুন কিছু করি মনে হয়নি ৷ ব্যবসা করতে পেলে পুঁজি দরকার ৷ কিন্তু সেটা আমার ছিল না ৷ হাঁড়ি চাপিয়ে ব্যবসা হয় না ৷ আজ কি খাব সেটা ভাবতে বসলে ব্যবসা হয় না ৷"

স্বপ্নের কথা জিজ্ঞাসা করলে হেসে ফেলন ৷ জানান, এখনও লড়ে যাচ্ছেন ৷ কত স্বপ্ন রয়েছে যা পূরণ করতে পারেননি ৷ সবাইকে নিয়ে থাকতে ভালোবাসেন ৷ আনন্দে থাকতে ভালোবাসেন ৷ কিন্তু মনের মধ্যে গুমরে ওঠা স্বপ্নগুলো যে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে 81 বছর বয়সে এসে তা নিয়ে ভেবে যে আর লাভ নেই, সেই বাস্তব স্বীকার করে নিয়েছেন ৷ তিনি বলেন, "আমার ভীষণ ইচ্ছা ছিল নিজের একটা বাড়ি বানানোর ৷ মাথার ছাদ তৈরি করা নিজের টাকায় ৷ কিন্তু সেটা এজীবনে আর হবে না তা আমি জানি ৷ মেয়েদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে স্বপ্ন পূরণ করতে পারব না ৷ বাড়ি করার স্বপ্ন আমি নিজে পূরণ করতে চেয়েছিলাম ৷"

Bengal cartoonist-amar-laha
বৃষ্টির দিনে ছাতা মাথায় ব্যাঙ সোনা (ইটিভি ভারত)

বস কেমন ? প্রশ্নের উত্তরে অমর বাবু কর্ণধার সুব্রত রায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ৷ তিনি বলেন, "স্যার ভীষণ ভালো ৷ বস হিসাবে অসাধারণ ৷ কোম্পানির সবচেয়ে প্রিয় লোক ৷ সবার সমস্যা মেটান ৷ ওঁনাকে নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই আমার ৷ উনিই আমাকে তুলে এনে এখানে বসিয়েছেন ৷ উনি আমার পেটের ভাতের জোগান করে দিয়েছেন ৷ সেখানে দাঁড়িয়ে আমি অতিরিক্ত কিছু চাইতে পারব না ৷ তাতে আমার কম পারিশ্রমিক হোক, কিচ্ছু যায় আসে না ৷ উনি নিজে থেকে যদি কোনও কিছু ভালোবেসে দেন সেটাই আমি নেব ৷"

হায়দরাবাদ, 3 জুন: প্রায় একমাস হতে চলল বিশ্বজুড়ে পালিত হয়েছে ওয়ার্ল্ড কার্টুনিস্ট ডে (world cartoonist day) ৷ কার্টুন বললেই মনে পড়ে যায় বাঙালি কার্টুন শিল্পী নারায়ণ দেবনাথ, শৈলনারায়ণ চক্রবর্তী-র মতো ব্যক্তিত্বদের নাম ৷ ছোটবেলায় 'নন্টে ফন্টে' বা 'শক্তিমান' বই ছোটদের অন্যতম আকর্ষণের বিষয় ছিল ৷ সময় পাল্টাচ্ছে ৷ এখন সবকিছুই ডিজিটাল ৷ কিন্তু তারমধ্যেই 81 বছর বয়সী শিল্পী অমর লাহা নিজের ছন্দে তৈরি করে চলেছেন একের পর এক কার্টুন চরিত্র ৷

কম্পিউটারের 'ক' জানেন না তিনি ৷ নেই আঁকার প্রথাগত শিক্ষাও ৷ বাঙালি ব্যঙ্গচিত্রী ও লেখক চণ্ডী লাহিড়ীর আঁকা দেখে হয়েছেন অনুপ্রাণিত ৷ বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি অ্যানিমেশন কোম্পানিতে চিত্রশিল্পী, ইলাসট্রেটর, কার্টুন শিল্পী হিসাবে কাজ করেন ৷ নামমাত্র পারিশ্রমিক হলেও ছোট থেকেই 'হাফ সিরিয়াস' প্রবীণ এই ব্যক্তি জীবনের আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন মজাদার আঁকাতেই ৷ তিনি বলেন, "আমি এমনই ছবি আঁকতাম ৷ কার্টুন আঁকতে মজা লাগত ৷ ভালো লাগে ৷ খুবই অভাবের সংসার ছিল ৷ হাল ধরতে 25-26 বছর বয়সে শঙ্কর ঘোষ লেনে একটা দোকানে কাজে লেগে পড়ি ৷"

Bengal cartoonist-amar-laha
শিক্ষার আলো (ইটিভি ভারত)

শিল্পী অমর বাবু কোথাও কাজ করে সুখ পাচ্ছিলেন না ৷ হাতের কাছে সাদা কাগজ-পেন্সিল পেলেই ক্যানভাসে উজাড় করতেন এক আকাশ কল্পনা ৷ প্রথম দিকে থাকতেন কলকাতার ঠনঠনিয়া কালিবাড়ির কাছে ৷ তারপর সেখান থেকে টালিগঞ্জের কুঁদঘাটে চলে আসেন ৷ ততদিনে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবরকম কাজ করে ফেলেছেন ৷ এরমধ্যেই একদিন ভাগ্য সদয় হয় ৷ 2010 সালে কলকাতার অন্যতম বেসরকারি অ্যানিমেশন কোম্পানির কর্ণধার সুব্রত রায়ের নজরে পড়েন শিল্পী অমর ৷ শিল্পীর কথায়, "রাস্তা থেকে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন ৷ তিনি আমাকে প্রথম আঁকা নিয়ে কাজের সুযোগ দেন ৷ কার্টুনের চরিত্র আঁকা, ইলাস্ট্রেশন করা সেই সব প্রফেশনালি শুরু করি ৷"

এখন সবকিছু এআই নির্ভর ৷ কার্টুনিস্টের জীবিকা কতটা বিপদের মুখে ? অমর লাহার জবাব, "খুবই বিপদের মধ্যে রয়েছে ৷ কম্পিউটারে একটা কার্টুন আঁকতে বেশি সময় লাগে না ৷ কিন্তু সাদা পাতায়, পেন্সিল দিয়ে সেই চরিত্র কল্পনা করে আঁকাটা সময় সাপেক্ষ বিষয় ৷ ভাবনা চিন্তা থাকে ৷ মানুষ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে ৷ সবকিছু তাড়াতাড়ি চায় ৷ দু'দিন বাদে হয়ত কার্টুনিস্ট হিসাবে কাজই পাব না ৷"

Bengal cartoonist-amar-laha
হাসছি মোরা হাসছি দেখো... (ইটিভি ভারত)

তাঁর কথায়, 'নন্টে ফন্টে'র মতো কার্টুন দেখে ছোটবেলা কেটেছে ৷ একটা কার্টুন আঁকার আগে তার চরিত্র নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে হয় ৷ তারপর এক-দুদিন লেগে যায় কার্টুনের মতো আঁকতে ৷ যারা এআই-এর সাহায্যে চরিত্র তৈরি করে তাঁদের ওপর অতিরিক্ত একটা প্রেশার থাকেই ৷ যেমন একজন ডাকাতের চরিত্র কেমন হবে তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে হয় ৷ যদি মধ্যবয়সী ডাকাত হয় তা কেমন দেখতে হবে সেই নিয়েও কল্পনা করতে হয় ৷ তারপর আসে আঁকা ৷

পরিবার বলতে অমর বাবুর দুই মেয়ে ও এক স্ত্রী আছেন ৷ দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ৷ তাঁরাও আজ সাবলম্বী ৷ অমর বাবুর কথায়, পরিবারের একমাত্র রোজগেরে বলতে তিনিই ছিলেন ৷ কঠিন সময় পেরিয়েছেন ৷ অল্প আয়ে দাঁতে দাঁত চেপে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন ৷ কিন্তু রসবোধ কমেনি এতটুকু ৷ শিল্পীর কথায়, "আমার কার্টুনের রসিকতা ভালো লাগে ৷ আমি খুব গম্ভীর লোক নই ৷ মজা করতে ভালোবাসি ৷ সেটাই আঁকার মধ্যে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি ৷ সেটাই আমার জিয়নকাঠি ৷ আমার মাথায় থাকে যে আঁকা দেখে লোক মজা পাবে ৷ আমি বাস্তবেও ছোট থেকেই মজা করতে ভালোবাসি ৷ আমার বাড়িতে সিরিয়াজ কাজ কেউ দেয় না ৷ খরচার খাতায় ধরে রাখে ৷"

Bengal cartoonist-amar-laha
বীর বাহাদুর (ইটিভি ভারত)

মজার ছলে অমর বাবু বলেন, "একদিন আমার স্ত্রী বাজার থেকে বাটা মাছ আনতে বলেছিল ৷ আমি মজার ছলে বলে ফেলেছিলাম, বাটা না পেলে শ্রীলেদার্স বা অন্য কিছু আনলে চলবে ? স্ত্রী রেগে গিয়ে বাজারের ব্যাগ কেড়ে নিয়েছিল ৷ তারপর বাজারের পয়সা ফেরত চেয়েছিল ৷" এহেন মানুষ নাকি শ্রাদ্ধ বাড়িতেও যেতে ভয় পেতেন ৷ পাছে কোনও হাসির কথা বলে ফেলেন ৷ যে কারণে নিজের জ্যাঠামশাইয়ের মৃত্যুর সময়েও তিনি পরিবারের সামনে যাননি ৷ কখন কোন কথায় কী বলে ফেলবেন, সেই নিয়ে তিনি নিজেও প্রচন্ড ভয়ে ছিলেন ৷

স্কুল ফাইনাল পাশ করেননি ৷ অভাবের সংসারে বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন কাজের ধান্দায় ঘুরতে হবে ৷ সেই থেকে হাতের কাছে যা পেয়েছেন একটার পর একটা কাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন ৷ কিন্তু মন বসাতে পারছিলেন না ৷ শিল্পী বলেন, "শিল্পী চণ্ডী লাহিড়ীর একটা আঁকা খুব পছন্দ হয়েছিল ৷ দেখে মনে হয়েছিল এতে আনন্দ আছে ৷ আমার প্রথম আঁকা 'ছেলেবেলা' ম্যাগাজিনে-র গল্পতে বেরিয়েছিল ৷ তখনই প্রথম সুযোগ পাই ৷ দাতব্য চিকিৎসালয়ের মতো এঁকে দিতাম সকলকে ৷ এক জুতো কোম্পানির হয়ে এঁকে প্রথম 14 আনা আয় করেছিলাম ৷ সালটা তখন 68-70 হবে ৷"

Bengal cartoonist-amar-laha
দোলনায় আস্ত কঙ্কাল (ইটিভি ভারত)
কথাতেই বলে, যে কাজে ভালোবাসা আছে সেই কাজ করে শান্তি পাওয়া যায় ৷ কিন্তু অর্থের প্রয়োজন কি মেটে ? সবার স্বপ্ন কি সত্যি হয় ? অমর লাহার কথায়, "স্যার দয়া করে রেখেছেন তাই আছি ৷ মাসিক বেতন এখনও 20 হাজারও পেরোয়নি ৷ আমি কাজে ব্যস্ত থাকতে চাই ৷ তাতে যদি কম টাকা হয় চলবে ৷ আমি চাইতে পারব না ৷ একার কাঁধে সংসার ৷ এই চাকরি ছেড়ে নতুন কিছু করি মনে হয়নি ৷ ব্যবসা করতে পেলে পুঁজি দরকার ৷ কিন্তু সেটা আমার ছিল না ৷ হাঁড়ি চাপিয়ে ব্যবসা হয় না ৷ আজ কি খাব সেটা ভাবতে বসলে ব্যবসা হয় না ৷"

স্বপ্নের কথা জিজ্ঞাসা করলে হেসে ফেলন ৷ জানান, এখনও লড়ে যাচ্ছেন ৷ কত স্বপ্ন রয়েছে যা পূরণ করতে পারেননি ৷ সবাইকে নিয়ে থাকতে ভালোবাসেন ৷ আনন্দে থাকতে ভালোবাসেন ৷ কিন্তু মনের মধ্যে গুমরে ওঠা স্বপ্নগুলো যে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে 81 বছর বয়সে এসে তা নিয়ে ভেবে যে আর লাভ নেই, সেই বাস্তব স্বীকার করে নিয়েছেন ৷ তিনি বলেন, "আমার ভীষণ ইচ্ছা ছিল নিজের একটা বাড়ি বানানোর ৷ মাথার ছাদ তৈরি করা নিজের টাকায় ৷ কিন্তু সেটা এজীবনে আর হবে না তা আমি জানি ৷ মেয়েদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে স্বপ্ন পূরণ করতে পারব না ৷ বাড়ি করার স্বপ্ন আমি নিজে পূরণ করতে চেয়েছিলাম ৷"

Bengal cartoonist-amar-laha
বৃষ্টির দিনে ছাতা মাথায় ব্যাঙ সোনা (ইটিভি ভারত)

বস কেমন ? প্রশ্নের উত্তরে অমর বাবু কর্ণধার সুব্রত রায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ৷ তিনি বলেন, "স্যার ভীষণ ভালো ৷ বস হিসাবে অসাধারণ ৷ কোম্পানির সবচেয়ে প্রিয় লোক ৷ সবার সমস্যা মেটান ৷ ওঁনাকে নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই আমার ৷ উনিই আমাকে তুলে এনে এখানে বসিয়েছেন ৷ উনি আমার পেটের ভাতের জোগান করে দিয়েছেন ৷ সেখানে দাঁড়িয়ে আমি অতিরিক্ত কিছু চাইতে পারব না ৷ তাতে আমার কম পারিশ্রমিক হোক, কিচ্ছু যায় আসে না ৷ উনি নিজে থেকে যদি কোনও কিছু ভালোবেসে দেন সেটাই আমি নেব ৷"

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.