ETV Bharat / bharat

স্থগিত সিন্ধু জল চুক্তি নিয়ে জল ঘোলা কেন ? কী এই বোঝাপড়া ? বিশ্লেষণে ইটিভি ভারত - INDUS WATER TREATY EXPLAINED

ভারতের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নদীর জল থেকে সিকি ভাগ জিডিপি আসে পাকিস্তানের ৷ যদি সেই জল বন্ধ হয়ে যায় তাহলে কতটা প্রভাবিত হবে পাকিস্তান ?

Patrolling along India-Pakistan Border
ভারত-পাকিস্তান জল সীমান্তে কড়া প্রহরা (ইটিভি ভারত)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : April 27, 2025 at 4:27 PM IST

Updated : April 27, 2025 at 4:53 PM IST

12 Min Read

হায়দরাবাদ, 27 এপ্রিল: পহেলগাঁওয়ের বৈসরনে পর্যটকদের উপর জঙ্গি হামলার পাল্টা জবাবে অন্য বেশ কিছু কড়া পদক্ষেপের পাশাপাশি পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু জল চুক্তিও স্থগিত করেছে ভারত ৷ বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু জল চুক্তি অবিলম্বে স্থগিত করছে ভারত ৷ এই মর্মে কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রকের তরফে সরকারি চিঠিও পাঠানো হয়েছে ইসলামাবাদে ৷ কিন্তু শেষমেশ সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত হওয়ায় কীভাবে এবং কতটা প্রভাবিত হবে পাকিস্তান ? উত্তর খুঁজল ইটিভি ভারত ৷

সিন্ধু জল চুক্তি কী ?

সিন্ধু নদ কৈলাস পর্বতের তিব্বতীয় মালভূমিতে উৎপন্ন হয়ে লাদাখ, গিলগিট-বালতিস্তান এবং করাচির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আরব সাগরে মিশেছে ৷ এর ছ'টি উপনদী - সিন্ধু, ঝিলাম, চেনাব (চন্দ্রভাগা), রাবি (ইরাবতী), সাতলুজ (শতদ্রু) এবং বিয়াস (বিপাশা) ৷ শুধুমাত্র পঞ্জাব প্রদেশের মধ্যে দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে চেনাব, ঝিলাম, ইরাবতী, বিপাশা এবং সাতলেজ ৷ এদের একসঙ্গে 'পঞ্চনদ' বলা হয় ৷ এই পাঁচটি নদী পঞ্জাব প্রদেশেরই মিঠানকোট নামক জায়গায় সিন্ধু নদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৷ এরপর সিন্ধু নদ আরব সাগরে মিশেছে ৷

পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার পরদিন বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রির সাংবাদিক বৈঠক (ভিডিয়ো এএনআই)

পঞ্চনদ

  • ঝিলাম নদী জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার ভেরিনাগ থেকে উৎপন্ন হয়ে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশে প্রবেশ করেছে ৷
  • হিমাচল প্রদেশের হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল থেকে উৎপন্ন চন্দ্র ও ভাগা নদীর জল থেকে গঠন হওয়া নদীরই পরে নাম হয়েছে, চেনাব ৷ এরপর জম্মুর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তা পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশে গিয়েছে ৷
  • সাতলেজ বা শতদ্রু নদীর উৎপত্তিস্থল তিব্বতের রক্ষাস্থল লেক ৷ নদীটি হিমাচল প্রদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিপাশা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে এবং পাকিস্তানের কসুর জেলা দিয়ে পঞ্জাব প্রদেশে প্রবেশ করেছে ৷
  • বিপাশা নদীর উৎসস্থল হিমাচল প্রদেশের রোটাং পাস পার্বত্য অঞ্চল ৷ সেখান থেকে উৎপন্ন হয়ে এই নদীটিও পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশে প্রবেশ করেছে ৷
  • ইরাবতী বা রাবি নদী হিমাচল প্রদেশের কাংরা ভ্যালি থেকে উৎপন্ন হয়েছে ৷ পরে পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশে প্রবাহিত হয়ে লাহোরের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে ৷ একে 'লাহোরের নদী'ও বলা হয় ৷

1947 সালে দেশভাগের পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু অববাহিকার উপনদীগুলির জলের বণ্টন নিয়ে সংঘাত তৈরি হয় ৷ দুই দেশ তখনও কৃষি-নির্ভর ৷ এই পরিস্থিতিতে 1952 সালের মে মাসের 6 তারিখ বিশ্বব্যাঙ্কের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইউজিন ব্ল্যাকের উদ্যোগে একটি বৈঠক হয় ওয়াশিংটনে ৷ সেই শুরু । তারপর দীর্ঘ আট বছর ধরে জল ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে ৷

The signing of the Indus Water Treaty, September 19, 1960: (left to right) Prime Minister Nehru of India; President Ayub Khan of Pakistan; and World Bank Vice President Sir William Iliff
সিন্ধু জল চুক্তিতে স্বাক্ষর করছেন (বাঁদিক থেকে) প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান এবং বিশ্বব্যাঙ্কের সহ-সভাপতি স্যর উইলিয়াম ইলিফ (ছবি সৌজন্য: বিশ্বব্যাঙ্ক)

শেষে 1960 সালের 19 সেপ্টেম্বর করাচিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু জল চুক্তি (ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি বা আইডব্লিউটি) সম্পন্ন হয় ৷ মধ্যস্থতা করে বিশ্বব্যাঙ্ক ৷ স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ৷ বিশ্বব্যাঙ্ক পাকিস্তানকে চুক্তির বাস্তবায়নে অর্থসাহায্যও করেছিল ৷

সিন্ধু নদ ও তার উপনদীগুলির জলপ্রবাহকে একসঙ্গে 'ইন্দাস রিভার সিস্টেম' বা সিন্ধু জল ব্যবস্থা বলা হয় ৷ দু'দেশের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখাই এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্যে ৷

Indus River flowing from India to Pakistan
ভারত ও পাকিস্তানে সিন্ধু নদ ও তার উপনদীর অবস্থান (ইটিভি ভারত)

সিন্ধু জল ব্যবস্থায় ভারত-পাকিস্তান জল বণ্টন

এই চুক্তি অনুযায়ী সিন্ধু অববাহিকার পূর্বদিকের ইরাবতী, বিপাশা, শতদ্রু নদীর জলের সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব ভারতের ৷ আবার পশ্চিম দিকের সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব- এই তিনটি নদীর জলের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানের হাতে ৷

সিন্ধু ও তার উপনদীগুলির উৎস ভারতে ৷ সেগুলি ভারতের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে ৷ প্রাকৃতিক নিয়মে, নদীগুলির পার্বত্য প্রবাহের অনেকটা অংশ ভারতে ৷ পাকিস্তান সিন্ধুর নিম্ন অববাহিকায় অবস্থিত ৷ প্রাকৃতিক নিয়মেই সেখানে জলের স্রোত ভারতের তুলনায় কম ৷

এই চুক্তি ঠিকঠাক কার্যকর করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে 'পার্মানেন্ট ইন্দাস কমিশন' (পিআইসি) গঠন করা হয় ৷ এই কমিশনে ভারত ও পাকিস্তানের তরফে একজন করে কমিশনার রয়েছেন ৷ সিন্ধু জল ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনার জন্য প্রতি বছর অন্তত একবার কমিশনারদের মধ্যে বৈঠক হওয়া বাধ্যতামূলক ৷ সেই বৈঠক ভারত বা পাকিস্তানের মধ্যে যে কোনও একটি দেশে হতে পারে ৷ দুই দেশই এই সিন্ধু জল ব্যবস্থা পর্যালোচনা থেকে শুরু করে একে অপরকে হাইড্রোলজিক্যাল ডেটা বিনিময় করবে বলে ঠিক হয়েছিল ৷ সিন্ধু জল চুক্তি নিয়ে কোনও সমস্যা হলে প্রথমে পিআইসি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধানের চেষ্টা করবে ৷ তাতে সুরাহা না হলে কোনও নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ অথবা মধ্যস্থতাকারী আদালতের কাছে বিষয়টি পাঠানো যেতে পারে ৷

What is Indus Water Treaty
সিন্ধু জল চুক্তি কী ? (ইটিভি ভারত)

চুক্তির কয়েকটি বিশেষ দিক

সিন্ধু জল চুক্তিতে ভারত এই ব্যবস্থার মাত্র 20 শতাংশ জল ব্যবহার করতে পারে ৷ 33 মিলিয়ন অ্যাকর-ফিট (এমএএফ) বা বছরে 41 বিলিয়ন কিউবিক মিটার (বিসিএম) জল পায় ভারত ৷

অন্যদিকে, সিন্ধু জল ব্যবস্থার 80 শতাংশ জলের নিয়ন্ত্রণ আছে পাকিস্তানের কাছে ৷ 135 এমএএফ বা বছরে 99 বিসিএম জলের কর্তৃত্ব প্রতিবেশী দেশের ৷

চুক্তিতে বলা আছে, পশ্চিম দিকের নদীগুলির (ঝিলাম, চেনাব, সিন্ধু) প্রবাহে কোনও বাধা দেবে না ভারত ৷ একইভাবে পূর্ব দিকের নদীগুলির (শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী) প্রবাহ বইতে দেবে পাকিস্তান ৷

সিন্ধু জল চুক্তি মেনে প্রতি বছর 5,900 টিএমসিএফটি (হাজার মিটার কিউবিক ফিট) জল পাকিস্তানকে দেয় ভারত ৷

Impact on Pakistan after Indus Water treaty placed in abeyance by India
সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করেছে ভারত (ইটিভি ভারত)

চুক্তি স্থগিত হলে পাকিস্তানের উপর প্রভাব

বিশ্বে যে দেশগুলির প্রবল জল সংকটে রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্য়তম পাকিস্তান ৷ দেশের 80 শতাংশ সেচ ও কৃষি হয় পূর্ব দিকের নদীর (ঝিলাম, চেনাব ও সিন্ধু) জলে ৷ 16 মিলিয়ন বা 1.6 কোটি হেক্টর জমিতে কৃষিকাজ হয় সিন্ধু জল ব্যবস্থা থেকে পাওয়া জল থেকে ৷

এই জলের 93 শতাংশ ব্যবহৃত হয় দেশের সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৷

পাকিস্তানের 61 শতাংশ মানুষ সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলের বাসিন্দা ৷ এই চুক্তি থেকে প্রাপ্ত জলের উপর নির্ভর করে বেঁচে রয়েছেন প্রায় 23.7 কোটি মানুষ ৷

পাকিস্তানের প্রধান শহর করাচি, লাহোর ও মুলতান সরাসরি এই নদীগুলির জল ব্যবহার করে ৷

পাকিস্তানের দু'টি গুরুত্বপূর্ণ বাঁধ মঙ্গলা ও তারবেলায় 14.4 মিলিয়ন একর ফিট (এমএএফ) জল ধারণ করে রাখা সম্ভব, যা প্রতি বছর দেশের প্রয়োজনীয় জলের মাত্র 10 শতাংশ ৷

বর্ষার মরশুমে বৃষ্টি না হলে বা জলের প্রবাহ ঠিক না থাকলে চরম সমস্যার মুখে পড়তে হয় পাকিস্তানকে ৷

পাকিস্তানের জিডিপি'র 25 শতাংশ আসে এই জল ব্যবস্থা থেকে ৷

India Pakistan Water Sharing
সিন্ধু জল চুক্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের জলের ভাগাভাগি (ইটিভি ভারত)

ভারত যদি পূর্ব দিকের নদীর জল প্রবাহ বন্ধ করে দেয়

সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব নদীর প্রবাহ যদি কোনওভাবে ভারত বন্ধ করে বা স্থগিত রাখে, তাহলে পাকিস্তান অনেকাংশে প্রভাবিত হবে বলেই মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল ৷ প্রভাব পড়বে খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ৷

ভারত কী কী করতে পারে ?

ভারতের তরফে ছ'বছরেরও বেশি সময় ধরে আইডব্লিউটি-র কমিশনার হিসাবে কাজ করেছেন প্রদীপ কুমার সাক্সেনা ৷ তিনি সংবাদসংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছেন, "ভারত সিন্ধু নদের পার্বত্য প্রবাহের দেশ ৷ তাই ভারতের কাছে অনেকগুলি বিকল্প আছে ৷ যদিও চুক্তিতে স্পষ্ট করে বাতিলের ব্যবস্থা বলা নেই, তবু ভারত সরকার যদি সিন্ধু জল চুক্তি বাতিল করতে চায়, তাহলে স্থগিত করা অবশ্যই তার প্রথম ধাপ ৷ পশ্চিম দিকের নদীগুলির (ঝিলাম, চেনাব, সিন্ধু) মধ্যে ঝিলাম নদীতে কিষাণগঙ্গা জলাধার এবং জম্মু-কাশ্মীরের বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট রয়েছে ৷ এই প্রজেক্টগুলি সিন্ধুর উচ্চ-অববাহিকায় অবস্থিত হওয়ার দরুন ভারত 'রিজার্ভার ফ্লাশিং' অর্থাৎ উচ্চগতিতে জল ছাড়তে পারে ৷ কিন্তু, সিন্ধু জল চুক্তিতে এই কাজ করা সম্ভব নয় ৷

সাক্সেনা আরও জানিয়েছেন, শুধু যে জল চুক্তির জন্যই ফ্লাশিং করা সম্ভব হয় না, তা নয় । ফ্লাশিং-এর ফলে ভারতের জলাধারও খালি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় এবং পুরো জলাধার ভর্তি করতে বেশ কিছু দিন সময় লাগে ৷ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এই সিন্ধু জল চুক্তি অনুযায়ী, একমাত্র অগস্ট মাসে, মানে ভরা বর্ষার মরশুমেই জলাধার ভর্তি করার ছাড়পত্র রয়েছে ৷ কিন্তু চুক্তি স্থগিত করলে যে কোনও সময়ে হাইস্পিড ফ্লাশিং করা যাবে এবং এর ফলে যে প্রবল জলের স্রোত তৈরি হবে, তাতে মূলত পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্লাবন দেখা দিতে পারে ৷ এর সঙ্গে সঙ্গে পাক-পঞ্জাবে কৃষিকাজের প্রাথমিক পর্যায়ের বীজ রোপণের কাজও ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৷

জলাধারের ফ্লাশিং কাকে বলে ?

জলাধারের তলায় যে বিপুল পরিমাণে কাদা-মাটি জমা হয়, তা পরিষ্কার করতে ফ্লাশিং করা হয়। প্রবল গতিতে জলাধারের জল ছাড়ার ফলে স্রোতের তোড়ে জলাধারের তলায় জমা হওয়া সেডিমেন্ট বা কাদা-মাটি ধুয়ে যায় ৷ এর ফলে জলাধারের জল ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় ৷

কীভাবে হয় এই ফ্লাশিং?

ফ্লাশিং পদ্ধতির একমাত্র শর্ত হল প্রথমে জলাধারটিকে জলশূন্য করে ফেলা ৷ আর তাই প্রবল গতিতে বাঁধ বা কোনও জলাশয়ে জল ছেড়ে দেওয়াই হল ফ্লাশিং-এর প্রথম পদক্ষেপ ৷ জলের পরিমাণ কমে এলে, তারপর বাঁধ বা জলাশয়ের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে হাত দেওয়া হয় ৷

সিন্ধু জল চুক্তি নিয়ে বিবাদ

1960 সালে বিশ্বব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় হওয়া সিন্ধু জল চুক্তি বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী কূটনৈতিক বোঝাপড়া ৷ এই চুক্তির ফলে এখনও পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে জলের ভাগাভাগি নিয়ে কোনও যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি ৷ বিভিন্ন সময়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলেছে, কিন্তু পরিস্থিতি যতই উত্তপ্ত হোক, সিন্ধু জল চুক্তির উপর তার কোনও প্রভাব পড়েনি ৷

Debashree Mukherjee (Secretary, Ministry of Jal Shakti, Govt of India) has sent a letter to Syed Ali Murtaza (Secretary, Ministry of Water Resources, Pakistan)
ভারতের জলশক্তি মন্ত্রকের তরফে পাকিস্তানের জল শক্তি মন্ত্রককে পাঠানো চিঠি (পিটিআই)

ভারত-পাক দ্বন্দ্ব, কী বলছে ইতিহাস ?

স্বাধীনতার পর গত সাত দশকে বারবার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র আকার নিয়েছে ৷ হয়েছে যুদ্ধ ৷ সন্ত্রাস বন্ধ না হলে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও আলোচনা করবে না বলে স্পষ্ট জানিয়েছে ভারত ৷ একনজরে দেখে নেওয়া যাক উত্তেজনার সেই সব ফেলে আসা দিন-

  • 1965 সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ
  • 1971 সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
  • 1999 সালে কার্গিল যুদ্ধ
  • 2001 সালে ভারতীয় সংসদ ভবনে হামলা
  • 2008 সালে মুম্বইয়ে জঙ্গি হামলা
  • 2016 সালে কাশ্মীরের উরি সেনাঘাঁটিতে হামলা
  • 2019 সালে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় হামলা

সাম্প্রতিক অতীতে (2019 সালের 14 ফেব্রুয়ারি) পুলওয়ামায় সেনা জওয়ানদের গাড়ির উপর সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনায় 40 জন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানের মৃত্যু হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে ৷ সেবারও সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করার কথা উঠেছিল ৷ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, "রক্ত ও জল একসঙ্গে বইতে পারে না ৷" কিন্তু শেষ মুহূর্তে, ভারত চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে ৷ তবে এবার সেই পথে হেঁটেছে ভারত ৷

গত 22 এপ্রিল পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় ভরা পর্যটনের মরশুমে জঙ্গি হামলা হয় ৷ জম্মু-কাশ্মীরের অর্থনীতি পর্যটন-নির্ভর ৷ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটির অসংখ্য মানুষের আয়ের মূল উৎসই হল এই পর্যটন ৷ ওইদিন বৈসরন উপত্যকায় প্রায় 40 জন পর্যটক ছিলেন ৷ হঠাৎ পাইন ও দেবদারু গাছের জঙ্গলের আড়াল থেকে সেনা-জওয়ানদের পোশাকে বেরিয়ে আসে জঙ্গিরা ৷ তারা পর্যটকদের নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করে ৷ তারপর তাঁদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে ৷ এই নৃশংস তাণ্ডবলীলায় 26 জনের মৃত্যু হয়েছে ৷ তাঁদের মধ্যে একজন নেপালের বাসিন্দা ৷

স্তম্ভিত করে দেওয়া এই হামলার দায় স্বীকার করেছে লস্কর-ই-তইবার ছায়া সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফোর্স বা টিআরএফ ৷ ঘটনার পরদিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বে বৈঠকে বসে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি ৷ সেখানেই নেওয়া কয়েকটি সিদ্ধান্তের মধ্যে ছিল সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতের বিষয়টিও ৷

ভারতের জলশক্তি মন্ত্রী সিআর পাটিল ইতিমধ্যেই বলেছেন, "পাকিস্তানে যেন একটি ফোঁটাও জল না পৌঁছয়, সেই ব্যবস্থা করছে কেন্দ্রীয় সরকার ৷ তার জন্য স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত করা হচ্ছে ৷ জল বন্ধ করতে শীঘ্রই নদী খনন ও নদীর গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়ার কাজও শুরু হবে ৷"

The road between Srinagar to Kargil along the border with Pakistan, river Indus in Kashmir on July 07, 2013, India
কাশ্মীরে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে শ্রীনগর থেকে কার্গিল যাওয়ার রাস্তায় বয়ে চলেছে সিন্ধু নদী (ইটিভি ভারত)

বিগত দু'বছর ধরে সিন্ধু জল চুক্তি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে ৷ জম্মু-কাশ্মীরের বান্দিপোরা জেলায় ঝিলাম নদীতে 330 মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কিষাণগঙ্গা হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্রজেক্ট (কেএইচইপি) এবং কিশতওয়ার জেলায় চেনাব নদীর উপর 850 মেগাওয়াটের ব়্যাটল হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্রজেক্ট নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল পাকিস্তান ৷ 2023 সালের 25 জানুয়ারি ভারত সিন্ধু জল চুক্তিতে বদল চেয়ে পাকিস্তানকে নোটিশ পাঠিয়েছিল ৷ এরপর ফের সেপ্টেম্বরে জল চুক্তির 'পর্যালোচনা ও পরিবর্তনে'র কথা জানিয়ে নোটিশ পাঠায় ভারত ৷ কিন্তু প্রতিবারই পাকিস্তান সেই আলোচনা পিছিয়ে দেয় ৷

তবে পহেলগাওঁ জঙ্গি হামলা বদলে দিয়েছে অনেক কিছু । সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত হয়ে যাওয়ার ফলে, ভরা গ্রীষ্মে এবং তারপর বর্ষার সময়ে নিম্ন সিন্ধু নদ অববাহিকায় কী পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং তার প্রভাব পাকিস্তানে কতটা পড়ে, সেটাই দেখার ৷

হায়দরাবাদ, 27 এপ্রিল: পহেলগাঁওয়ের বৈসরনে পর্যটকদের উপর জঙ্গি হামলার পাল্টা জবাবে অন্য বেশ কিছু কড়া পদক্ষেপের পাশাপাশি পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু জল চুক্তিও স্থগিত করেছে ভারত ৷ বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু জল চুক্তি অবিলম্বে স্থগিত করছে ভারত ৷ এই মর্মে কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রকের তরফে সরকারি চিঠিও পাঠানো হয়েছে ইসলামাবাদে ৷ কিন্তু শেষমেশ সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত হওয়ায় কীভাবে এবং কতটা প্রভাবিত হবে পাকিস্তান ? উত্তর খুঁজল ইটিভি ভারত ৷

সিন্ধু জল চুক্তি কী ?

সিন্ধু নদ কৈলাস পর্বতের তিব্বতীয় মালভূমিতে উৎপন্ন হয়ে লাদাখ, গিলগিট-বালতিস্তান এবং করাচির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আরব সাগরে মিশেছে ৷ এর ছ'টি উপনদী - সিন্ধু, ঝিলাম, চেনাব (চন্দ্রভাগা), রাবি (ইরাবতী), সাতলুজ (শতদ্রু) এবং বিয়াস (বিপাশা) ৷ শুধুমাত্র পঞ্জাব প্রদেশের মধ্যে দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে চেনাব, ঝিলাম, ইরাবতী, বিপাশা এবং সাতলেজ ৷ এদের একসঙ্গে 'পঞ্চনদ' বলা হয় ৷ এই পাঁচটি নদী পঞ্জাব প্রদেশেরই মিঠানকোট নামক জায়গায় সিন্ধু নদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৷ এরপর সিন্ধু নদ আরব সাগরে মিশেছে ৷

পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার পরদিন বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রির সাংবাদিক বৈঠক (ভিডিয়ো এএনআই)

পঞ্চনদ

  • ঝিলাম নদী জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার ভেরিনাগ থেকে উৎপন্ন হয়ে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশে প্রবেশ করেছে ৷
  • হিমাচল প্রদেশের হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল থেকে উৎপন্ন চন্দ্র ও ভাগা নদীর জল থেকে গঠন হওয়া নদীরই পরে নাম হয়েছে, চেনাব ৷ এরপর জম্মুর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তা পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশে গিয়েছে ৷
  • সাতলেজ বা শতদ্রু নদীর উৎপত্তিস্থল তিব্বতের রক্ষাস্থল লেক ৷ নদীটি হিমাচল প্রদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিপাশা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে এবং পাকিস্তানের কসুর জেলা দিয়ে পঞ্জাব প্রদেশে প্রবেশ করেছে ৷
  • বিপাশা নদীর উৎসস্থল হিমাচল প্রদেশের রোটাং পাস পার্বত্য অঞ্চল ৷ সেখান থেকে উৎপন্ন হয়ে এই নদীটিও পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশে প্রবেশ করেছে ৷
  • ইরাবতী বা রাবি নদী হিমাচল প্রদেশের কাংরা ভ্যালি থেকে উৎপন্ন হয়েছে ৷ পরে পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশে প্রবাহিত হয়ে লাহোরের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে ৷ একে 'লাহোরের নদী'ও বলা হয় ৷

1947 সালে দেশভাগের পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু অববাহিকার উপনদীগুলির জলের বণ্টন নিয়ে সংঘাত তৈরি হয় ৷ দুই দেশ তখনও কৃষি-নির্ভর ৷ এই পরিস্থিতিতে 1952 সালের মে মাসের 6 তারিখ বিশ্বব্যাঙ্কের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইউজিন ব্ল্যাকের উদ্যোগে একটি বৈঠক হয় ওয়াশিংটনে ৷ সেই শুরু । তারপর দীর্ঘ আট বছর ধরে জল ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে ৷

The signing of the Indus Water Treaty, September 19, 1960: (left to right) Prime Minister Nehru of India; President Ayub Khan of Pakistan; and World Bank Vice President Sir William Iliff
সিন্ধু জল চুক্তিতে স্বাক্ষর করছেন (বাঁদিক থেকে) প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান এবং বিশ্বব্যাঙ্কের সহ-সভাপতি স্যর উইলিয়াম ইলিফ (ছবি সৌজন্য: বিশ্বব্যাঙ্ক)

শেষে 1960 সালের 19 সেপ্টেম্বর করাচিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু জল চুক্তি (ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি বা আইডব্লিউটি) সম্পন্ন হয় ৷ মধ্যস্থতা করে বিশ্বব্যাঙ্ক ৷ স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ৷ বিশ্বব্যাঙ্ক পাকিস্তানকে চুক্তির বাস্তবায়নে অর্থসাহায্যও করেছিল ৷

সিন্ধু নদ ও তার উপনদীগুলির জলপ্রবাহকে একসঙ্গে 'ইন্দাস রিভার সিস্টেম' বা সিন্ধু জল ব্যবস্থা বলা হয় ৷ দু'দেশের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখাই এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্যে ৷

Indus River flowing from India to Pakistan
ভারত ও পাকিস্তানে সিন্ধু নদ ও তার উপনদীর অবস্থান (ইটিভি ভারত)

সিন্ধু জল ব্যবস্থায় ভারত-পাকিস্তান জল বণ্টন

এই চুক্তি অনুযায়ী সিন্ধু অববাহিকার পূর্বদিকের ইরাবতী, বিপাশা, শতদ্রু নদীর জলের সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব ভারতের ৷ আবার পশ্চিম দিকের সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব- এই তিনটি নদীর জলের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানের হাতে ৷

সিন্ধু ও তার উপনদীগুলির উৎস ভারতে ৷ সেগুলি ভারতের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে ৷ প্রাকৃতিক নিয়মে, নদীগুলির পার্বত্য প্রবাহের অনেকটা অংশ ভারতে ৷ পাকিস্তান সিন্ধুর নিম্ন অববাহিকায় অবস্থিত ৷ প্রাকৃতিক নিয়মেই সেখানে জলের স্রোত ভারতের তুলনায় কম ৷

এই চুক্তি ঠিকঠাক কার্যকর করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে 'পার্মানেন্ট ইন্দাস কমিশন' (পিআইসি) গঠন করা হয় ৷ এই কমিশনে ভারত ও পাকিস্তানের তরফে একজন করে কমিশনার রয়েছেন ৷ সিন্ধু জল ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনার জন্য প্রতি বছর অন্তত একবার কমিশনারদের মধ্যে বৈঠক হওয়া বাধ্যতামূলক ৷ সেই বৈঠক ভারত বা পাকিস্তানের মধ্যে যে কোনও একটি দেশে হতে পারে ৷ দুই দেশই এই সিন্ধু জল ব্যবস্থা পর্যালোচনা থেকে শুরু করে একে অপরকে হাইড্রোলজিক্যাল ডেটা বিনিময় করবে বলে ঠিক হয়েছিল ৷ সিন্ধু জল চুক্তি নিয়ে কোনও সমস্যা হলে প্রথমে পিআইসি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধানের চেষ্টা করবে ৷ তাতে সুরাহা না হলে কোনও নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ অথবা মধ্যস্থতাকারী আদালতের কাছে বিষয়টি পাঠানো যেতে পারে ৷

What is Indus Water Treaty
সিন্ধু জল চুক্তি কী ? (ইটিভি ভারত)

চুক্তির কয়েকটি বিশেষ দিক

সিন্ধু জল চুক্তিতে ভারত এই ব্যবস্থার মাত্র 20 শতাংশ জল ব্যবহার করতে পারে ৷ 33 মিলিয়ন অ্যাকর-ফিট (এমএএফ) বা বছরে 41 বিলিয়ন কিউবিক মিটার (বিসিএম) জল পায় ভারত ৷

অন্যদিকে, সিন্ধু জল ব্যবস্থার 80 শতাংশ জলের নিয়ন্ত্রণ আছে পাকিস্তানের কাছে ৷ 135 এমএএফ বা বছরে 99 বিসিএম জলের কর্তৃত্ব প্রতিবেশী দেশের ৷

চুক্তিতে বলা আছে, পশ্চিম দিকের নদীগুলির (ঝিলাম, চেনাব, সিন্ধু) প্রবাহে কোনও বাধা দেবে না ভারত ৷ একইভাবে পূর্ব দিকের নদীগুলির (শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী) প্রবাহ বইতে দেবে পাকিস্তান ৷

সিন্ধু জল চুক্তি মেনে প্রতি বছর 5,900 টিএমসিএফটি (হাজার মিটার কিউবিক ফিট) জল পাকিস্তানকে দেয় ভারত ৷

Impact on Pakistan after Indus Water treaty placed in abeyance by India
সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করেছে ভারত (ইটিভি ভারত)

চুক্তি স্থগিত হলে পাকিস্তানের উপর প্রভাব

বিশ্বে যে দেশগুলির প্রবল জল সংকটে রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্য়তম পাকিস্তান ৷ দেশের 80 শতাংশ সেচ ও কৃষি হয় পূর্ব দিকের নদীর (ঝিলাম, চেনাব ও সিন্ধু) জলে ৷ 16 মিলিয়ন বা 1.6 কোটি হেক্টর জমিতে কৃষিকাজ হয় সিন্ধু জল ব্যবস্থা থেকে পাওয়া জল থেকে ৷

এই জলের 93 শতাংশ ব্যবহৃত হয় দেশের সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৷

পাকিস্তানের 61 শতাংশ মানুষ সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলের বাসিন্দা ৷ এই চুক্তি থেকে প্রাপ্ত জলের উপর নির্ভর করে বেঁচে রয়েছেন প্রায় 23.7 কোটি মানুষ ৷

পাকিস্তানের প্রধান শহর করাচি, লাহোর ও মুলতান সরাসরি এই নদীগুলির জল ব্যবহার করে ৷

পাকিস্তানের দু'টি গুরুত্বপূর্ণ বাঁধ মঙ্গলা ও তারবেলায় 14.4 মিলিয়ন একর ফিট (এমএএফ) জল ধারণ করে রাখা সম্ভব, যা প্রতি বছর দেশের প্রয়োজনীয় জলের মাত্র 10 শতাংশ ৷

বর্ষার মরশুমে বৃষ্টি না হলে বা জলের প্রবাহ ঠিক না থাকলে চরম সমস্যার মুখে পড়তে হয় পাকিস্তানকে ৷

পাকিস্তানের জিডিপি'র 25 শতাংশ আসে এই জল ব্যবস্থা থেকে ৷

India Pakistan Water Sharing
সিন্ধু জল চুক্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের জলের ভাগাভাগি (ইটিভি ভারত)

ভারত যদি পূর্ব দিকের নদীর জল প্রবাহ বন্ধ করে দেয়

সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব নদীর প্রবাহ যদি কোনওভাবে ভারত বন্ধ করে বা স্থগিত রাখে, তাহলে পাকিস্তান অনেকাংশে প্রভাবিত হবে বলেই মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল ৷ প্রভাব পড়বে খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ৷

ভারত কী কী করতে পারে ?

ভারতের তরফে ছ'বছরেরও বেশি সময় ধরে আইডব্লিউটি-র কমিশনার হিসাবে কাজ করেছেন প্রদীপ কুমার সাক্সেনা ৷ তিনি সংবাদসংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছেন, "ভারত সিন্ধু নদের পার্বত্য প্রবাহের দেশ ৷ তাই ভারতের কাছে অনেকগুলি বিকল্প আছে ৷ যদিও চুক্তিতে স্পষ্ট করে বাতিলের ব্যবস্থা বলা নেই, তবু ভারত সরকার যদি সিন্ধু জল চুক্তি বাতিল করতে চায়, তাহলে স্থগিত করা অবশ্যই তার প্রথম ধাপ ৷ পশ্চিম দিকের নদীগুলির (ঝিলাম, চেনাব, সিন্ধু) মধ্যে ঝিলাম নদীতে কিষাণগঙ্গা জলাধার এবং জম্মু-কাশ্মীরের বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট রয়েছে ৷ এই প্রজেক্টগুলি সিন্ধুর উচ্চ-অববাহিকায় অবস্থিত হওয়ার দরুন ভারত 'রিজার্ভার ফ্লাশিং' অর্থাৎ উচ্চগতিতে জল ছাড়তে পারে ৷ কিন্তু, সিন্ধু জল চুক্তিতে এই কাজ করা সম্ভব নয় ৷

সাক্সেনা আরও জানিয়েছেন, শুধু যে জল চুক্তির জন্যই ফ্লাশিং করা সম্ভব হয় না, তা নয় । ফ্লাশিং-এর ফলে ভারতের জলাধারও খালি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় এবং পুরো জলাধার ভর্তি করতে বেশ কিছু দিন সময় লাগে ৷ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এই সিন্ধু জল চুক্তি অনুযায়ী, একমাত্র অগস্ট মাসে, মানে ভরা বর্ষার মরশুমেই জলাধার ভর্তি করার ছাড়পত্র রয়েছে ৷ কিন্তু চুক্তি স্থগিত করলে যে কোনও সময়ে হাইস্পিড ফ্লাশিং করা যাবে এবং এর ফলে যে প্রবল জলের স্রোত তৈরি হবে, তাতে মূলত পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্লাবন দেখা দিতে পারে ৷ এর সঙ্গে সঙ্গে পাক-পঞ্জাবে কৃষিকাজের প্রাথমিক পর্যায়ের বীজ রোপণের কাজও ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৷

জলাধারের ফ্লাশিং কাকে বলে ?

জলাধারের তলায় যে বিপুল পরিমাণে কাদা-মাটি জমা হয়, তা পরিষ্কার করতে ফ্লাশিং করা হয়। প্রবল গতিতে জলাধারের জল ছাড়ার ফলে স্রোতের তোড়ে জলাধারের তলায় জমা হওয়া সেডিমেন্ট বা কাদা-মাটি ধুয়ে যায় ৷ এর ফলে জলাধারের জল ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় ৷

কীভাবে হয় এই ফ্লাশিং?

ফ্লাশিং পদ্ধতির একমাত্র শর্ত হল প্রথমে জলাধারটিকে জলশূন্য করে ফেলা ৷ আর তাই প্রবল গতিতে বাঁধ বা কোনও জলাশয়ে জল ছেড়ে দেওয়াই হল ফ্লাশিং-এর প্রথম পদক্ষেপ ৷ জলের পরিমাণ কমে এলে, তারপর বাঁধ বা জলাশয়ের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে হাত দেওয়া হয় ৷

সিন্ধু জল চুক্তি নিয়ে বিবাদ

1960 সালে বিশ্বব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় হওয়া সিন্ধু জল চুক্তি বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী কূটনৈতিক বোঝাপড়া ৷ এই চুক্তির ফলে এখনও পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে জলের ভাগাভাগি নিয়ে কোনও যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি ৷ বিভিন্ন সময়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলেছে, কিন্তু পরিস্থিতি যতই উত্তপ্ত হোক, সিন্ধু জল চুক্তির উপর তার কোনও প্রভাব পড়েনি ৷

Debashree Mukherjee (Secretary, Ministry of Jal Shakti, Govt of India) has sent a letter to Syed Ali Murtaza (Secretary, Ministry of Water Resources, Pakistan)
ভারতের জলশক্তি মন্ত্রকের তরফে পাকিস্তানের জল শক্তি মন্ত্রককে পাঠানো চিঠি (পিটিআই)

ভারত-পাক দ্বন্দ্ব, কী বলছে ইতিহাস ?

স্বাধীনতার পর গত সাত দশকে বারবার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র আকার নিয়েছে ৷ হয়েছে যুদ্ধ ৷ সন্ত্রাস বন্ধ না হলে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও আলোচনা করবে না বলে স্পষ্ট জানিয়েছে ভারত ৷ একনজরে দেখে নেওয়া যাক উত্তেজনার সেই সব ফেলে আসা দিন-

  • 1965 সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ
  • 1971 সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
  • 1999 সালে কার্গিল যুদ্ধ
  • 2001 সালে ভারতীয় সংসদ ভবনে হামলা
  • 2008 সালে মুম্বইয়ে জঙ্গি হামলা
  • 2016 সালে কাশ্মীরের উরি সেনাঘাঁটিতে হামলা
  • 2019 সালে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় হামলা

সাম্প্রতিক অতীতে (2019 সালের 14 ফেব্রুয়ারি) পুলওয়ামায় সেনা জওয়ানদের গাড়ির উপর সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনায় 40 জন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানের মৃত্যু হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে ৷ সেবারও সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করার কথা উঠেছিল ৷ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, "রক্ত ও জল একসঙ্গে বইতে পারে না ৷" কিন্তু শেষ মুহূর্তে, ভারত চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে ৷ তবে এবার সেই পথে হেঁটেছে ভারত ৷

গত 22 এপ্রিল পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় ভরা পর্যটনের মরশুমে জঙ্গি হামলা হয় ৷ জম্মু-কাশ্মীরের অর্থনীতি পর্যটন-নির্ভর ৷ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটির অসংখ্য মানুষের আয়ের মূল উৎসই হল এই পর্যটন ৷ ওইদিন বৈসরন উপত্যকায় প্রায় 40 জন পর্যটক ছিলেন ৷ হঠাৎ পাইন ও দেবদারু গাছের জঙ্গলের আড়াল থেকে সেনা-জওয়ানদের পোশাকে বেরিয়ে আসে জঙ্গিরা ৷ তারা পর্যটকদের নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করে ৷ তারপর তাঁদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে ৷ এই নৃশংস তাণ্ডবলীলায় 26 জনের মৃত্যু হয়েছে ৷ তাঁদের মধ্যে একজন নেপালের বাসিন্দা ৷

স্তম্ভিত করে দেওয়া এই হামলার দায় স্বীকার করেছে লস্কর-ই-তইবার ছায়া সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফোর্স বা টিআরএফ ৷ ঘটনার পরদিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বে বৈঠকে বসে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি ৷ সেখানেই নেওয়া কয়েকটি সিদ্ধান্তের মধ্যে ছিল সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতের বিষয়টিও ৷

ভারতের জলশক্তি মন্ত্রী সিআর পাটিল ইতিমধ্যেই বলেছেন, "পাকিস্তানে যেন একটি ফোঁটাও জল না পৌঁছয়, সেই ব্যবস্থা করছে কেন্দ্রীয় সরকার ৷ তার জন্য স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত করা হচ্ছে ৷ জল বন্ধ করতে শীঘ্রই নদী খনন ও নদীর গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়ার কাজও শুরু হবে ৷"

The road between Srinagar to Kargil along the border with Pakistan, river Indus in Kashmir on July 07, 2013, India
কাশ্মীরে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে শ্রীনগর থেকে কার্গিল যাওয়ার রাস্তায় বয়ে চলেছে সিন্ধু নদী (ইটিভি ভারত)

বিগত দু'বছর ধরে সিন্ধু জল চুক্তি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে ৷ জম্মু-কাশ্মীরের বান্দিপোরা জেলায় ঝিলাম নদীতে 330 মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কিষাণগঙ্গা হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্রজেক্ট (কেএইচইপি) এবং কিশতওয়ার জেলায় চেনাব নদীর উপর 850 মেগাওয়াটের ব়্যাটল হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্রজেক্ট নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল পাকিস্তান ৷ 2023 সালের 25 জানুয়ারি ভারত সিন্ধু জল চুক্তিতে বদল চেয়ে পাকিস্তানকে নোটিশ পাঠিয়েছিল ৷ এরপর ফের সেপ্টেম্বরে জল চুক্তির 'পর্যালোচনা ও পরিবর্তনে'র কথা জানিয়ে নোটিশ পাঠায় ভারত ৷ কিন্তু প্রতিবারই পাকিস্তান সেই আলোচনা পিছিয়ে দেয় ৷

তবে পহেলগাওঁ জঙ্গি হামলা বদলে দিয়েছে অনেক কিছু । সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত হয়ে যাওয়ার ফলে, ভরা গ্রীষ্মে এবং তারপর বর্ষার সময়ে নিম্ন সিন্ধু নদ অববাহিকায় কী পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং তার প্রভাব পাকিস্তানে কতটা পড়ে, সেটাই দেখার ৷

Last Updated : April 27, 2025 at 4:53 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.