নয়াদিল্লি, 12 এপ্রিল: রাষ্ট্রপতিকে তাঁর কাছে পাঠানো বিল নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরণ করিয়ে দিল শীর্ষ আদালত ৷ রাজ্যপাল, কোনও বিল রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য তাঁর কাছে পাঠালে রাষ্ট্রপতিকে সেই তারিখ থেকে তিন মাসের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে মনে করছে আদালত ৷ এই প্রথম দেশের সাংবিধানিক প্রধান, রাষ্ট্রপতিকে তাঁর কাছে পাঠানো বিল নিয়ে কী করণীয়, তা উল্লেখ করল শীর্ষ আদালত ৷
এর আগে গত 8 এপ্রিল তামিলনাড়ুর রাজ্যপালকে বিল আটকে রাখা নিয়ে তীব্র ভর্ৎসনা করে বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা ও বিচারপতি আর মহাদেবনের বেঞ্চ ৷ পাশাপাশি আদালত স্পষ্ট জানায় অনন্তকাল ধরে বিল আটকে রাখার কোনও অধিকার রাজ্যপালের নেই ৷ তা স্বেচ্ছাচারিতার সামিল এবং অবৈধ ৷
এবার রাষ্ট্রপতির কাছে রাজ্যপালের পাঠানো বিল নিয়ে সেই তারিখ থেকে তিন মাসের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিল দুই বিচারপতির বেঞ্চ ৷ শুক্রবার রাত 10.54 মিনিটে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে বিল সংক্রান্ত 415 পাতার রায় আপলোড করা হয়েছে ৷ তাতে দেশের সব রাজ্যপালকে বিল নিয়ে পদক্ষেপ করার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন দুই বিচারপতি ৷
2023 সালের নভেম্বর থেকে তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল আরএন রবি তাঁর কাছে পাঠানো 10টি গুরুত্বপূর্ণ বিল রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য আটকে রেখেছিলেন ৷ এদিকে সেই বিলগুলি বিধানসভায় দু'দুবার পাশ করানোর পর রাজ্যপালের সম্মতির জন্য তাঁর কাছে পাঠানো হয়েছিল ৷ এই পরিস্থিতিতে রাজ্যপাল আরএন রবির এই বিল আটকে রাখা অবৈধ বলে উল্লেখ করেছে সুপ্রিম কোর্ট ৷
রাষ্ট্রপতি ব্যতিক্রম নন
বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা ও বিচারপতি আর মহাদেবনের বেঞ্চ জানিয়েছে, সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যপালের কোনও বিল দীর্ঘ দিন ধরে আটকে রাখার কোনও ক্ষমতা নেই ৷ এই প্রসঙ্গে দুই বিচারপতি রাষ্ট্রপতির প্রসঙ্গে জানিয়েছে, "একই ভাবে সংবিধানের 201 নম্বর ধারার আওতায় রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রেও এক বিধান কার্যকর হওয়া উচিত ৷ রাষ্ট্রপতিও সংবিধানের এই নিয়মের ব্যতিক্রম নন ৷ রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপাল- এই দুই সাংবিধানিক পদাধিকারীর কারও হাতে এই ধরনের অবাধ ক্ষমতা রয়েছে, তা বলা যায় না ৷"
দুই বিচারপতির বেঞ্চের তরফে বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এই রায়টি লিখেছেন ৷ রাষ্ট্রপতির ভূমিকা নিয়ে তিনি 201 নম্বর ধারার উল্লেখ করেছেন ৷ এই ধারার আওতায়, রাষ্ট্রপতি কোনও যথার্থ কারণ ছাড়া বিলগুলি আটকে রাখলে, তা সংবিধানের মৌলিক নীতির বিরোধিতা বলে গণ্য করা হবে ৷ যেখানে সংবিধান স্পষ্ট জানিয়েছে, ক্ষমতাকে ইচ্ছমতো ব্যবহার করা যায় না ৷ বিলগুলি নিয়ে কোনও পদক্ষেপ না-করলে সেই আচরণ গুরুতর বলে ধরা হবে ৷ এই নিষ্ক্রিয়তা যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারার প্রতি ধ্বংসাত্মক ৷ তাই 201 নম্বর ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিরও অহেতুক দেরি করার কোনও সুযোগ থাকছে না ৷
নিষ্ক্রিয়তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়
বেঞ্চ আরও জানিয়েছে, "আমরা জানি, 201 নম্বর ধারায় রাষ্ট্রপতিকে প্রদেয় ক্ষমতা অনুযায়ী তিনি বিল বিবেচনা করে দেখতে পারেন ৷ তার জন্য কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি ৷ এতদসত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি বিলগুলি নিয়ে কোনও পদক্ষেপ না করলে তাও যুক্তিগ্রাহ্য নয় ৷" দুই বিচারপতির বেঞ্চের পরামর্শ, 201 নম্বর ধারায় রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সময়সীমার কথা উল্লেখ করা নেই ৷ এই অবস্থায় তিন মাসের মেয়াদ গুরুত্বপূর্ণ ৷
শীর্ষ আদালতের বক্তব্য, "রাষ্ট্রপতি হয়তো তিন মাসের মধ্যে বিল নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তের কথা জানালেন না ৷ সেক্ষেত্রে তিনি কেন তা করলেন না, সেই কারণগুলি লিপিবদ্ধ করে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকে জানাতে হবে ৷ রাজ্যকে এই ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে ৷ বিল নিয়ে ওঠা প্রশ্নগুলির উত্তর দ্রুত পাঠাতে হবে রাজ্যকে ৷ পাশাপাশি এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া পরামর্শগুলিও খতিয়ে দেখতে হবে ৷ পুরো বিষয়টি দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে ৷"
এক্ষেত্রে বেঞ্চের বার্তা, এটা স্পষ্ট করা দরকার, কোনও সাংবিধানিক পদাধিকারী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিল নিয়ে কোনও পদক্ষেপ না করলে সুপ্রিম কোর্ট সেই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে ৷ আদালতের সেই ক্ষমতা আছে ৷
রাজ্য সরকারের ক্ষমতায়ন
রাজ্য সরকার বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলগুলি রাজ্যপালের কাছে পাঠায় ৷ তিনি তাঁর ক্ষমতার ব্যবহার করে মন্ত্রিসভার পরামর্শ ও সাহায্য না নিয়ে বিলগুলি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে থাকেন ৷ সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকার বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট অথবা সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হতে পারে ৷
এখানে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের 201 নম্বর ধারার ব্যাখ্যা দিয়েছে ৷ রাজ্য ও কেন্দ্রের সম্পর্কের টানাটানি নেপথ্যে কারণ রয়েছে এই ধারাতে ৷ 201 নম্বর ধারা অনুযায়ী, রাজ্যপাল, রাষ্ট্রপতির কাছে বিল পাঠালে তিনি কখন তাতে সম্মতি জানাবেন সে নিয়ে কোনও সময়সীমার উল্লেখ নেই ৷ তাই রাষ্ট্রপতি যদি বিলটি ফেলে রাখেন, তাহলে বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলটির কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হবে ৷
এই বিষয়ে সংবিধান কী বলছে, তা উল্লেখ করে শীর্ষ আদালত ৷ সংবিধানের 200 নম্বর ধারা অনুযায়ী, রাজ্যপাল তাঁর কাছে আসা বিলগুলিতে সম্মতি দিতেও পারেন, নাও দিতে পারেন ৷ তিনি বিলটি রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য তাঁর কাছে পাঠাতে পারেন ৷ রাষ্ট্রপতি কতদিনের মধ্যে বিলে স্বাক্ষর করবেন, সেই বিষয়ে সংবিধানে কোনও সময়সীমার উল্লেখ নেই ৷
তিন মাসের সময়সীমা নতুন নয়
রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতির বিল আটকে রাখা প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের জারি করা স্মারকলিপির কথা তুলে ধরেছে সুপ্রিম কোর্ট ৷ 2016 সালের 4 ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক অফিস মেমোরান্ডাম (ওএম) জারি করে ৷ এই স্মারকলিপিতে, কেন্দ্রীয় সরকারের সব মন্ত্রক ও দফতরকে রাষ্ট্রপতির সম্মতির অপেক্ষায় থাকা বিলগুলিকে দ্রুত ছাড়পত্র দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় ৷
বেঞ্চের কথায়, "এই নির্দেশে এটা পরিষ্কার যে, রাষ্ট্রপতির জন্য অপেক্ষায় থাকা বিলগুলি নিয়ে সিদ্ধান্তের জন্য তিন মাস সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৷ জরুরি ভিত্তিতে অধ্যাদেশ নিষ্পত্তির জন্য তিন সপ্তাহের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৷"
বিচারপতি পারদিওয়ালা বলেন, "স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের এই নির্দেশিকা অনুযায়ী আমরা মনে করছি, রাষ্ট্রপতির কাছে রাজ্যপালের পাঠানো বিল নিয়ে সেই তারিখ থেকে তিন মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন ৷"