হায়দরাবাদ: জীবনের শুরুর দিকটা খুবই সাধারণ ছিল ৷ একেবারে সাদামাটা মানুষ থেকে তেলেগুদের কাছে মহান হয়ে ওঠেন তিনি ৷ জীবন সংগ্রামে প্রতিটি যুদ্ধে তিনি জয়ী হয়েছেন ৷ প্রতি মুহূর্তে তিনি কিছু না কিছু শিখেছেন ৷ একহাতে হাজার জনের কাজ করার ক্ষমতা ছিল তাঁর মধ্যে ৷ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বাহুবলী ৷ একটাই জীবনে একজনের পক্ষে এতকিছু অর্জন করা সম্ভব ? রামোজি রাওয়ের এই যাত্রাপথ সত্যি সবাইকে অবাক করে দেবে ৷
এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রামোজি রাও ৷ পরে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন ৷ কেউ কেউ বলে তিনি যা স্পর্শ করতেন, তাই সোনা হয়ে যেত ৷ কিন্তু প্রতিটি অর্জনের নেপথ্যে তাঁর গভীর ভাবনা, কৌশল, সংগ্রাম, প্রচেষ্টা, এবং পরিশ্রমকে খুব কম লোকই বুঝতে পেরেছিল ৷ একটি পাথরকে রত্নে পরিণত করার ক্ষমতা ছিল তাঁর ৷ প্রতিকূল সময়েও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সদর্থক ছিল ৷ জটিলতার মধ্যেও তিনি সুযোগ দেখতে পেতেন ৷ তাঁর একটাই মন্ত্র ছিল: পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন এগিয়ে চলো, পিছনে দেখো না ৷ লক্ষ্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত তিনি থামতেন না ৷
সাংবাদিকতায় অজস্র পথ খুলে দিয়েছিলেন রামোজি রাও ৷ সারাজীবন ধরে সাংবাদিকতার মান ধরে রেখেছিলেন ৷ ভারতের সংবাদমাধ্যমের ইতিহাসে একটি দাগ কেটে গিয়েছেন তিনি, যা কোনও দিন মোছা যাবে না ৷ রঙিন হেডলাই, দুর্ধর্ষ ছবি, জেলার জন্য সংস্করণ, বিশেষ পাতা, মহিলাদের জন্য বসুন্ধরা, এনাডু ৷ রবিবারের ক্রোড়পত্র ছিল বইয়ের মতো এবং তুলনাহীন ৷ তেলেগু পাঠকদের কী চাই, তা তাঁর মতো আর কেউ বুঝতে পারেনি ৷ শিক্ষামূলক চাডুভু, সুখীভব, ই-নাডু, সিরি, ই-তরম, হি বুজ্জি, মকরন্দম এবং আহা, ইনাডু-তে সেই প্রতিফলন স্পষ্ট ৷
The passing away of Shri Ramoji Rao Garu is extremely saddening. He was a visionary who revolutionized Indian media. His rich contributions have left an indelible mark on journalism and the world of films. Through his noteworthy efforts, he set new standards for innovation and… pic.twitter.com/siC7aSHUxK
— Narendra Modi (@narendramodi) June 8, 2024
দৈনন্দিন খবরের কাগজ থেকে শুরু করে সাপ্তাহিক এবং মাসিক পত্রিকা, বিভিন্ন ভাষার টিভি চ্যানেল থেকে ওয়েবসাইট- সমাজকে জাগরণে রামোজি রাও একাধিক মঞ্চ ব্যবহার করেছিলেন ৷ তেলেগুভাষী জনমানসে সচেতনতা বৃদ্ধি, রাজনৈতিক দিক দিয়ে সজাগ করে তোলা এবং মানুষের মধ্যে জ্ঞান বিতরণে তাঁর ভূমিকা বিশাল ব্যাপ্ত ৷ অভাবনীয় ইস্যুগুলিকে মানুষের সামনে তুলে ধরে মানুষকে জাগিয়ে তুলতেন তিনি ৷ খবরের কাগজে ছবির মূল্য কী, তা তিনিই প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন ৷ কৃত্রিম আলো ছাড়া আসল ছবি ছাপার উপর জোর দিতেন তিনি ৷ কখনও কখনও হাজার হাজার ছবির মধ্যে থেকে নিজে বাছাই করে নিতেন ৷ পরের দিন সেই ছবিগুলিই টিভির অনুষ্ঠানে এমনকী বিধানসভাতেও চর্চার বিষয়বস্তু হয়ে উঠত ৷ তাঁর পর আর কেউ এই দূরদর্শিতা দেখাতে পারেননি ৷
খবরের কাগজকে মানুষের হাতে অস্ত্র হিসাবে তুলে দিয়েছিলেন রামোজি রাও ৷ তেলেগু সমাজ সংস্কারে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয় ৷ 1983 সালে তিনি তেলুগু দেশম পার্টিকে সমর্থন করেন ৷ এরপর যখন টিডিপির মিশন সফল হল, তখন তিনি স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি মানুষের সঙ্গে রয়েছেন ৷ 1984 সালে গণতান্ত্রিক সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল ইনাডু ৷ বিষয়বস্তুর পেশাদারিত্ব, প্রতিবেদনের নীতি, উৎপাদনের মান, প্রচার, বিতরণ, অথবা বিজ্ঞাপন- যাই হোক না কেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে মানদণ্ড তৈরি করে দিয়েছিলেন রামোজি রাও ৷ তিনি জোর দিয়েছিলেন, সাংবাদিকতার একমাত্র মানদণ্ড হল যোগ্যতা এবং প্রচেষ্টা ৷ তিনি তাঁর সংবাদপত্রটিকে এমনভাবে পরিচালনা করেছিলেন, যাতে তা ব্যক্তি-নির্ভর না হয়ে যায় ৷
তিনি বিশ্বাস করতেন, একজনের বয়স বাড়তে পারে, কিন্তু সংবাদপত্র যেন সর্বদা সতেজ থাকে ৷ পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারলে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানগুলি ধ্বংস হয়ে যায় ৷ তাঁর এই সতর্কবাণী প্রতিষ্ঠানের জন্য যেমন প্রযোজ্য, তেমনই ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রেও ৷ পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে টিকে রয়েছে ইনাডু ৷ তার কারণ নিরন্তর উদ্ভাবন এবং গতি ৷ রামোজি রাও বিশ্বাস করতেন, একটি সংবাদপত্রকে শুধু প্রতিবেদনে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, তার বাইরে যেতে হবে ৷ সংকটকালে সংবাদপত্রকে এগিয়ে গিয়ে নেতৃত্বের জায়গা নিতে হবে ৷ হাজার হাজার সাংবাদিক এবং পেশাদাররা তাঁর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের জীবন খুঁজে পেয়েছেন ৷ আজ ভারতের বেশিরভাগ শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমের পেশাদারদের শিকড় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে ইনাডু অথবা ইটিভিতে রয়েছে ৷ এটা বললেও অত্যুক্তি হবে না যে তাঁর প্রভাবে প্রভাবিত হননি, এমন কোনও ভারতীয় সাংবাদিক নেই ৷
ইনাডুর সম্পাদক হিসেবে তিনি ছিলেন নির্ভীক ৷ সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সঙ্গে তিনি কখনও আপস করেননি ৷ যেখানেই সংবাদপত্রের অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, সেখানেই তিনি লড়াই করেছেন ৷ এডিটরস গিল্ড অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি হিসেবে তিনি সেই স্বাধীনতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ৷ সাংবাদিকতায় তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল ইনাডুর আগেই অন্নদাতা পত্রিকা দিয়ে ৷ এই পত্রিকায় তাঁর কৃষক পটভূমি গভীরভাবে প্রোথিত ৷ এই পত্রিকা তেলুগু কৃষকদের কাছে বিশ্বের কৃষির খবর পৌঁছে দিত ৷
সাংবাদিকতায় অসংখ্য নতুন নতুন উদ্ভাবনের পথিকৃৎ ইনাডু ৷ ইনাডু টেলিভিশন মিডিয়াকে যেভাবে নতুন রূপ দিয়েছে, তা তুলনাহীন ৷ সকালে কফির সঙ্গে ইনাডু, রাতে খাওয়ার সময় ইটিভির খবর দেখা- সব মিলিয়ে ইনাডু তেলুগুদের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে ৷ ইটিভির 24 ঘণ্টার সংবাদ চ্যানেলগুলি একটি অনন্য ধারা বজায় রেখেছিল ৷ কোনও রকম চাঞ্চল্য ছাড়া বাস্তবতার কাছাকাছি ৷ ইটিভি অভিরুচুই, ইটিভি হেলথ, ইটিভি লাইফ, ইটিভি প্লাস এবং সিনেমার মতো চ্যানেলগুলি বৈচিত্র্য যোগ করেছিল ৷ ইটিভি বালা ভারত শিশুদের কাছে জ্ঞানের জগৎ খুলে দিয়েছে ৷ ভারতজুড়ে আঞ্চলিক ভাষার চ্যানেলগুলির পথিকৃৎ ছিলেন রামোজি রাও ৷ ইটিভি ভারতের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী সংবাদ নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন তিনি ।
তেলুগু ভাষা ছিল তাঁর হৃদস্পন্দন ৷ আধুনিক যুগের সমর্থক রামোজি ইংরেজি আধিপত্য বৃদ্ধির যুগে মুদ্রণ ও সম্প্রচারের মাধ্যমে খাঁটি তেলুগু প্রচার করেছিলেন ৷ মাসিক পত্রিকা ভিপুলা এবং চতুরা সহজ বোধগম্য ভাষায় সাহিত্য এবং গল্প প্রকাশ করেছে ৷ তিনি তেলুগু ভেলুগু, বালা ভারতম প্রকাশ করেছিলেন এবং এমনকী একটি তেলুগু কথ্য অভিধানও প্রকাশ করেছিলেন ৷ সিনেমা বিষয়ক সিতারা পত্রিকা এবং ইংরেজি সংবাদপত্র নিউজটাইমও পরিচালনা করেছিলেন রামোজি রাও ৷
জনসাধারণের মতামত তাঁর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৷ তিনি নিজে সমালোচনার জবাব দিতেন ৷ সঠিক সমালোচনা গ্রহণ করতেন এবং ভুল সংশোধন করতেন ৷ তাঁর স্বাক্ষরিত হাজার হাজার চিঠি এখন অমূল্য সম্পদ ৷ কোনও বিস্তারিত প্রতিবেদনের প্রতিটি শব্দ বিশ্লেষণে কর্মীদের মতামতের প্রতি সমান মনোযোগ দিতেন তিনি ।
মার্গদর্শী রামোজি রাও চিটফান্ড ব্যবসাকে কর্পোরেট মানে উন্নীত করেছিলেন ৷ 1962 সাল থেকে, মার্গাদর্শী দক্ষিণ ভারতে লক্ষ লক্ষ লোকের সেবা করেছে এবং এখন দেশের এক নম্বর চিটফান্ড ৷ রাজনৈতিক শক্তিগুলি যখন অন্যায়ভাবে এই চিটফান্ডকে নিশানা করেছিল, তখনও তিনি দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ৷ গুজবের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি যখন ভেঙে পড়ছিল, তখন মার্গদর্শী এবং রামোজি রাওয়ের প্রতি মানুষের আস্থা অটুট ছিল ৷
খাদ্য শিল্পে তাঁর অবদানও সমানভাবে যুগান্তকারী ছিল ৷ ঐতিহ্যবাহী গৃহস্থালির অঙ্গ প্রিয়া পিকলস আন্তর্জাতিক মানের রফতানি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছিল ৷ বিশাখাপত্তনমে ডলফিন হোটেলের মাধ্যমে আতিথেয়তার জগতে তাঁর প্রবেশ নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছিল ৷ বছরের পর বছর ধরে আধুনিকীকরণের ফলে, ডলফিন এই অঞ্চলের অন্যতম সেরা হয়ে উঠেছে ৷ রামোজি ফিল্ম সিটির অতিথিদেরও আতিথেয়তা দেয় এই হোটেল ৷
ফিল্ম সিটি ছিল রামোজি রাওয়ের স্বপ্নের প্রজেক্ট ৷ শহর থেকে অনেক দূরে অনুর্বর, পাথুরে জমিতে তৈরি, এই সিটি চলচ্চিত্রের উৎকর্ষতার একটি বিশ্বব্যাপী প্রতীক হয়ে উঠেছে ৷ 'একটি স্ক্রিপ্ট নিয়ে এসো, ফাইনাল মুদ্রণটি নিয়ে যাও'- এই প্রতিশ্রুতি RFC-তে বাস্তবে পরিণত হয়েছে ৷ তিন হাজারেরও বেশি চলচ্চিত্রের আয়োজন করেছে ফিল্ম সিটি ৷ এটি বিশ্বের বৃহত্তম চলচ্চিত্র প্রযোজনা কেন্দ্র হিসাবে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে জায়গা করে নিয়েছে ৷ ফিল্ম সিটি এখন সিরিয়াল এবং ওয়েব সিরিজ প্রযোজনাও করে ৷ আজ, প্রায় 15 লক্ষ পর্যটক প্রতি বছর রামোজি ফিল্ম সিটিতে ঘুরতে আসে, যা হায়দরাবাদের মুকুটে একটি রত্ন ৷
1983 সালে রামোজি ঊষা কিরণ মুভিজের মাধ্যমে চলচ্চিত্র প্রযোজনার নতুন পথ খুলে দেন ৷ সেখানে বার্তা থাকবে, স্বাস্থ্যকর বিনোদনও ৷ তাঁর ময়ূরী, মৌনাপোরতম এবং প্রতিঘটনের মতো সিনেমাগুলি ইতিহাস তৈরি করেছে ৷ চিত্রম এবং নুভভে কাভালি প্রমাণ করে দিয়েছে, কম বাজেটের ছবিগুলিও ব্যাপক সফল হতে পারে ৷ তিনি শত শত নতুন তারকা এবং প্রযুক্তিবিদদের নিয়ে কাজ করেছেন ৷ ETV WIN চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দল সফলভাবে ওটিটি-তে প্রবেশ করেছে এবং E-FMও পরিচালনা করে ৷
'কঠিন' এবং 'অসম্ভব' শব্দগুলি তাঁর শব্দভাণ্ডারে ছিল না ৷ তিনি বিশ্বাস করতেন, চ্যালেঞ্জ ছাড়া জীবন শূন্য ৷ তিনি চ্যালেঞ্জগুলি সরাসরি গ্রহণ করেছিলেন এবং সবাইকে চ্যালেঞ্জ গ্রহণে অনুপ্রাণিত করেছিলেন ৷ তাঁর একটি মাত্র ভাষণ শুনে অলসরা চাঙ্গা হয়ে উঠত ৷ লাজুকরা আত্মবিশ্বাসী বক্তায় পরিণত হতেন ৷ তিনি বিশ্বাস করতেন ডিগ্রির চেয়ে অধ্যবসায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ ৷ কারও মধ্যে কোনও স্ফুলিঙ্গ দেখতে পেলে তিনি তা লালন ও পরিমার্জন করতেন ৷ তাঁর নেতৃত্ব নিজেই ছিল একটি ব্যবস্থাপনা স্কুল, তাঁর নির্দেশনা, একটি মাস্টারক্লাস ৷
রামোজি রাও ছিলেন একজন অক্লান্ত চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব ৷ তিনি সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন, প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং হাজার হাজার মানুষকে আশ্রয় দিয়ে নিজেকে একটি বিশাল বটবৃক্ষে রূপান্তরিত করেছিলেন ৷ অর্ধ শতাব্দী ধরে তেলুগু রাজনীতি, মিডিয়া এবং সমাজে তাঁর প্রভাব ছিল অতুলনীয় ৷ তাঁর ছয় দশকের ব্যবসায়িক যাত্রাপথে তিনি একটি সাম্রাজ্য তৈরি করে গিয়েছেন ৷ যার সঙ্গে হাজার হাজার পরিবার যুক্ত ৷ খুব কম ভারতীয় ব্যবসায়ীই এত বিস্তারিত পদচিহ্ন রেখে যেতে সমর্থ হয়েছেন ৷ তাঁর বিশাল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ, ভারত সরকার তাঁকে 2016 সালে পদ্মবিভূষণে ভূষিত করে।
রামোজি রাও একজন কর্মযোগী ৷ যেখানে অন্ধকার, সেখানে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়েছেন তিনি ৷ শুধু একটা জীবন নয়, তিনি ঐতিহ্যের নাম রামোজি রাও ৷