কোটা, 29 মার্চ: 'কেউ হতে চায় ডাক্তার কেউ বা ইঞ্জিনিয়র...'- স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেড়িয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ধাপের দিকে এগিয়ে যান পড়ুয়ারা ৷ কেরিয়ার তৈরিতে জীবনের বড় পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে তাই অনেকেই পাড়ি জমান কোচিং হাব কোটায় ৷ আর সেখানেই ঘটছে যত বিপত্তি ৷ বিগত তিনমাসে মোট সাতজন পড়ুয়ার আত্মহত্যার ঘটনা এসেছে সামনে ৷ 10 বছরের নিরিখে সেই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে 149 ৷ কিন্তু একই জায়গায় বারবার কেন এই ধরনের ঘটনা ঘটছে? কী এমন মানসিক চাপ থাকে, যা নিতে পারেন না একজন পড়ুয়া? কী বলছেন মনস্তত্ত্ববিদ ও কোটার পুলিশ অফিসারা ৷ খোঁজ নিল ইটিভি ভারত ৷
কোটিং নগরী কোটা ৷ বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে এখান থেকে পড়াশোনা করে অনেক পড়ুয়ারা ভাল ফল করেছেন ৷ যে কারণে এখানে কোটিং নেযার বিষয়ে বাবা-মায়ের প্রত্যাশা বেড়েছে আগের থেকে ৷ প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় দৌঁড় লাগাচ্ছেন পড়ুয়ারা ৷ কেউ পড়ে যাচ্ছেন আবার কেউ যাচ্ছেন পিছিয়ে ৷ এই মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেক পড়ুয়াই বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ ৷
আত্মহত্যা বন্ধ করতে, শুধুমাত্র কোচিং ইনস্টিটিউট নয়, হোস্টেল এবং পিজিতেও আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। সরকারের নির্দেশে জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি পুলিশও বেশ কঠোর মনোভাব অবলম্বন করছে। কিন্তু তারপরেই এই বছর এখন পর্যন্ত কোটা শহরে সাতটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে 2014 সালে 14টি, 2015 সালে 23টি, 2016 সালে 17টি, 2017 সালে 7টি, 2018 সালে 20টি, 2019 সালে 8টি, 2020 সালে 4টি, 2021 সালে 4টি এবং 2022 সালে 25টি এবং এই 52 সালে 20টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
হস্টেল ও কোচিং ফ্যাকাল্টির দায়িত্ব নির্ধারণ করা হবে- কোটা শহরের পুলিশ অফিসার অমৃতা দুহান জানিয়েছেন যে হস্টেল বা পিজিতে আত্মহত্যার মতো ঘটনা সামনে আসলে তিনি নিজে ঘটনাস্থলে যান ৷ পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন ৷ কথা বলেন হস্টেল বা পিজি কর্তৃপক্ষদের সঙ্গেও ৷ সেখানকার লোকজন পড়ুয়াদের বিষণ্ণতার কথা জানত কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া পড়ুয়া যে প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতেন সেখানকার শিক্ষকদের সঙ্গেও কথা বলা হয় ৷ তিনি তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
পড়ুয়াদের জন্য পড়াশোনার সঠিক পরিবেশ তৈরি করা- ড. দুহান জানিয়েছেন, ক্রমাগত বিভিন্ন কোচিং সেন্টারগুলিতে পর্যবেক্ষণ বাড়ানো হয়েছে ৷ সেখানকার পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে ৷ এমনকী, কোচিং ইনস্টিটিউট ও হস্টেলের ভিত্তিতে পুলিশের উপস্থিতি বাড়ানো হচ্ছে, যাতে পড়ুয়ারা যে কোনও ধরনের সমস্যার কথা বলতে পারেন ৷ এরফলও মিলছে নাকি হাতেনাতে ৷ অনেক পড়ুয়া তাঁদের সমস্যার কথা বলার জন্য এগিয়ে আসছেন ৷ প্রশাসন ও পুলিশ যৌথভাবে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ৷ এই বিষয়টাকে মাথায় রাখা হয়েছে যে যে সকল পড়ুয়ারা অন্য রাজ্য থেকে এখানে পড়াশোনার জন্য আসছেন, তাঁদের একটা সুন্দর পরিবেশ দেওয়া আমাদের দায়িত্ব ৷
পাশপাশি, পুলিশ অফিসার অমৃতা আরও একটি বিষয়ের উপর জোর দেন ৷ তিনি জানান, যে সকল পড়ুয়ারা কোটা শহরে কোচিং করতে আসেন, তাঁদের পরিবার তথা বাবা-মা থাকেন অনেক দূরে ৷ অন্যদিকে পড়ুয়াদের উপর পড়াশোনার চাপ থাকে প্রতিনিয়ত। মানসিক চাপ তৈরি করে ৷ অন্যদিকে, দেখা যায়, অনেক পড়ুয়াকেই অনেকে হেনস্থা করেন ৷ সেটাও যাতে বন্ধ হয়, সেই দিকে কড়া নজরদারি চালানো হচ্ছে ৷ অবৈধ কাজ বা সমাজবিরোধী কাজের সঙ্গে যুক্ত এমন ব্যক্তিদের চিহ্নিত করছে পুলিশ ৷
এছাড়াও প্রশাসন ও পুলিশে তরফে বেশ কিছু বিষয়ের উপরে জোর দেওয়া হয়েছে ...
- মনোবিজ্ঞান এবং পড়াশোনার উন্নতির জন্য কোটার কোচিং ইনস্টিটিউটেও কাউন্সেলর রাখা হয়েছে। এই কাউন্সেলরের সংখ্যাও দুই শতাধিক। মানসিক চাপমুক্তি ও পড়াশোনার সময়সূচী সামঞ্জস্য করতে সহায়তা করেন এই সকল কাউন্সিলর।
- কোটার কোচিং ইনস্টিটিউটগুলিতে পড়াশোনার ফি রিফান্ড করার নীতি চালু করা হয়েছে ৷ একইভাবে, হস্টেলে শিক্ষার্থীরা যে টাকা জমা দিতেন, তাও ফেরত দেওয়ার নীতি নেওয়া হয়েছে ৷
- জেলা প্রশাসন সম্প্রতি কোটার সমস্ত কোচিং ইনস্টিটিউটে কর্মরত কর্মীদের পাশাপাশি হস্টেলে নিযুক্ত গার্ড ওয়ার্ডেন এবং কর্মরত ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে ৷ বিষণ্নতা বা আত্মহত্যার প্রবণতায় কারা ভুগছেন, তা দেখার দায়িত্ব থাকছে এদের উপরে ৷
- গঠন করা হয়েছে মহিলা স্কোয়াড, স্টুডেন্ট সেলও ৷ যাঁদের প্রতিনিয়ত কাজ থাকছে পড়ুয়াদের সব সমস্যা খতিয়ে দেখা ৷ মানসিক থেকে অনান্য বিষয়ে যেমন পড়ুয়াদের হয়রানি, পারস্পারিক বিরোধ ইত্যাদি সমস্যার সমাধান করা ৷
- এমনকী, কেন্দ্রীয় সরকারও কোচিং নিয়ে নির্দেশিকা জারি করেছে। যার অধীনে 16 বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি, কোচিং ইনস্টিটিউটগুলিকে রেজিস্ট্রেশন করানোয় জোর দেওয়া হয়েছে ৷
- কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের জারি করা নির্দেশিকা অনুসারে, 5 দিনের পড়াশোনা, উত্সবে ছুটি, অপ্রাপ্তবয়স্ক পড়ুয়াদের ভর্তি না করা, নির্বাচনের দাবিতে নিষেধাজ্ঞা, অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ না করার মতো বিষয় রয়েছে ৷ পাশাপাশি রয়েছে প্রতি 3 মাস অন্তর অভিভাবক-শিক্ষক সভা, সিসিটিভিতে নজরদারি, শিক্ষার্থীর উপস্থিতির সম্পূর্ণ নিরীক্ষণ ইত্যাদি ৷
কোটায় পড়ুয়াদের আত্মহত্যা নিয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন সিনিয়র মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এমএল আগরওয়াল ৷ তিনি জানিয়েছেন বেশ কিছু কারণের জন্য পড়ুয়ার এই ধরনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন ৷ তার মধ্যে হল-
-নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির কারণে পড়ুয়াদের উপর চাপ বাড়ছে
-সন্তানের জন্য বাবা-মা কী করছেন, তা বারবার বোঝানো
-কোটায় পড়াশোনা খরচ-সহ অনান্য খরচ
-বাড়ছে প্রতিযোগিতা, কঠিন পরীক্ষার লড়াইয়ে চ্যালেঞ্জ
-বারবার চেষ্টা করেও সাফল্য না পাওয়া
-পারিবারিক আত্মহত্যার ইতিহাস
-পড়াশোনা থেকে আগ্রহ হারানো
-পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকা
-পাশাপাশি, পর্নোগ্রাফি, স্মার্টফোন, গেমিং এবং সোশ্যাল মিডিয়া
এডুকেশন এক্সপার্ট দেব শর্মা জানান, কীভাবে মানসিক চাপমুক্ত থাকা যায়
1- প্রথমেই তিনি জানান, কেরিয়ার বাছা উচিত নিজের পছন্দ মতো ৷ অন্য জন কোন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছে, তা দেখে বিষয় বাছা উচিত নয় ৷
2- কেরিয়ার বাছার সময় থাকা উচিত প্ল্যান বি ৷ অর্থাৎ যদি সন্তান ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়র না হতে চায়, তাহলে সে অনঅয কোনও প্রফেশন বেছে নিতে পারে ৷
3- আবেগ দিয়ে কাজ করে এমন সন্তানের বাবা-মায়েরও কাউন্সেলিং করানো উচিত ৷
4- আত্মহত্যার মতো ঘটনার ভিডিয়ো অনেক সময় সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় ৷ সেই ধরনের ভিডিয়ো যাতে না ছড়ায় নজর দেওয়া উচিত ৷
5- সোশাল মিডিয়া থেকেও দূরে থাকা উচিত ৷ মোবাইলে ইন্টারনেট পরিষেবা যদি পড়াশোনার জন্য ব্যবহার করা হয় ভালো ৷
6- পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথা বলা উচিত ৷ পাশাপাশি বাবা-মায়েরও উচিত, সন্তানের মনোবাল বাড়ানো ৷
প্রশাসন ও পুলিশের তরফে নানা রকমের ব্যবস্থা ও সহযোগিতা প্রদানের পর কোটায় পড়ুয়াদের আত্মহত্যার সংখ্যা কমে কি না, সেটাই দেখার ৷
আরও পড়ুন
1. যদি বন্ধু হও... বয়ঃসন্ধিতে সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব নয়, আসুন মনের কাছাকাছি
2. মন্দিরের রীতি, গোঁফদাড়ি কামিয়ে ঐতিহ্যবাহী মহিলা বেশে পুজো দিলেন পুরুষরা
3. জানুয়ারি-মার্চে অফিস স্পেসের চাহিদা তুঙ্গে 6টি শহরে, তালিকায় নেই কলকাতা