নয়াদিল্লি, 20 মার্চ: প্রতি পাঁচ বছর অন্তর দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ হয় একেবারে খাতায়-কলমে। বিধানসভা থেকে লোকসভা নির্বাচন, দেশ স্বাধীন হতেই ভোট যেন হয়ে উঠেছে এক উদযাপন । সেই উদযাপনেই বার বার ফিরে আসে কথা দেওয়া ও রাখার পালা ৷ তবে এই কথা দেওয়া-নেওয়ার প্রক্রিয়ায় দিনে দিনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন মহিলারা ৷ তাঁদের ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য, লেখাপড়ার দিকটি ৷ ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে মহিলাদের ঘিরে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দেয় প্রায় সব রাজনৈতিক দল ৷ এহেন দেশে মহিলা ভোটারের সংখ্যাটাও নেহাত কম নয় ৷
এবছরে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক উৎসবের দিন আসন্ন ৷ তাতে সামিল হবেন দেশের 97 কোটিরও বেশি স্বীকৃত ভোটার, যার প্রায় অর্ধেক-ই মহিলা ৷ 2024 সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজের পছন্দের প্রার্থী বেছে নেবেন প্রায় 48 কোটি মহিলা ৷ এমনকী প্রথমবার ভোট দিচ্ছেন যাঁরা, সেই তরুণ প্রজন্মে মহিলার সংখ্যা 1.41 কোটি, যা প্রথমবারের পুরুষ ভোটদাতাদের থেকে 15 শতাংশ বেশি ৷ সব মিলিয়ে পুরুষ ভোটার ও মহিলা ভোটারের ছবিটা দাঁড়ায়- 1 হাজার জন পুরুষ ভোট দিলে, সেই তুলনায় মহিলা ভোটারের সংখ্যা 948 জন ৷
দেশের প্রথম লোকসভা ভোটে কিন্তু মহিলাদের এমন সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল না ৷ সমাজ ছিল অনেকাংশেই পুরুষকেন্দ্রিক ৷ তাদের মুখাপেক্ষী হয়েই চলত সংসার থেকে সমাজ, অর্থনীতি ৷ তখন ভোটকেন্দ্রে যাওয়া তো দূরঅস্ত, নিজমুখে অচেনা কাউকে নিজের নাম বলার সাহসটুকুও ছিল না মহিলাদের ৷ এমনই একটা সময় 1952 সাল ৷ স্বাধীন ভারতে প্রথম লোকসভা নির্বাচন ৷ দেশজুড়ে এই প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান করছেন এক বাঙালি, সুকুমার সেন ৷ তিনিই দেশের প্রথম মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার ।
দেশে প্রথম লোকসভা ভোটে নারী-পুরুষ- সবাই ভোট দিয়ে কেন্দ্রে সরকার গড়বে ৷ নির্বাচিত হবেন প্রধানমন্ত্রী ৷ এসব নিয়ে আমজনতাকে সচেতন করতে বিশেষ প্রচার চলছে সারা দেশে ৷ তখন যোগাযোগ বলতে বিপুলাকায় টেলিফোন মাত্র ৷ যাতায়াতে সাধারণ উপায় রেল থেকে বাস ৷ শহরের রাস্তায় গরুর গাড়ির দেখা মেলে ৷ মোবাইল সে যুগে কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি ৷ এরকম একটা কালে ভোটকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের নাম, পরিচয় সংগ্রহ করছেন ৷ দুর্গম প্রত্যন্ত এলাকাতেও যেতে হচ্ছে ৷ কার্যত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তৈরি হচ্ছে ভোটার তালিকা ৷ এরই মধ্যে এক অদ্ভুত সমস্যায় পড়লেন ভোটকর্মীরা ৷
এক নয়, দুই নয়- লক্ষ লক্ষ বাড়ির মহিলারা নিজেদের নাম বলছেন না, বলতে চাইছেন না ৷ আড়াল থেকে তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন কারও স্ত্রী, কারও মেয়ে, কারও বোন হিসেবে ৷ অগত্যা সেই পরিচয় জোগাড় করলেন ভোটকর্মীরা ৷ তালিকা তৈরির পর দেখা গেল, দেশে মহিলা ভোটারের সংখ্যা 8 কোটি ৷ এদিকে লক্ষ লক্ষ এমন মহিলা ভোটার আছেন, যাঁরা নিজেদের নাম বলতে চাননি ৷ তালিকায় তাঁরা কারও স্ত্রী তো কারও মেয়ে ৷ ভোটারের নাম থাকবে না, এটা মেনে নিতে চাননি মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার সুকুমার সেন ৷ নির্বাচন কমিশন সেই তালিকা থেকে 28 লক্ষ মহিলা ভোটারের নাম বাদ দিল ৷ 2024 সালের প্রথমবারের ভোটাররা হয়তো এমনটা বিশ্বাস করতে পারবেন না ৷ কিন্তু, সরকারি রিপোর্ট তাই বলছে ৷
এর 67 বছর পর গত লোকসভা নির্বাচনে অর্থাৎ 2019 সালে দেশজুড়ে চালু হল পিঙ্ক বুথ ৷ শুধুমাত্র মহিলা ভোটারদের জন্য ৷ গোলাপি রঙের এই বুথে প্রিসাইডিং অফিসার থেকে শুরু করে সব ভোটকর্মীরাই মহিলা ৷ মহিলারা যাতে নিরাপদে, স্বচ্ছন্দে ভোট দিতে পারেন, তাই এই বিশেষ ব্যবস্থা ৷ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যুগে পার্লামেন্ট পেপারলেস ৷ এই যুগে সরকার গড়ায় তাই বড়সড়ো অংশীদার নারী ৷ প্রায় সব রাজনৈতিক দলের প্রার্থীতালিকায় মহিলাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো ৷ তাঁদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা প্রাধান্য পাচ্ছে রাজনীতির হাটে-বাজারে ।
ইতিহাস ক্রমবর্ধমান । সভ্যতার আধুনিকতা সেই ক্রমবর্ধমানের পথ ধরেই । যেখানে, সেকাল-একাল হয়তো আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, যখন দেখা যায় সার্বিক বাধা পেরিয়ে এক নারী সামনে আসেন নিজের ভোট প্রয়োগে । যে নারী চব্বিশের ভারতে সংখ্যাতত্ত্বের উপর চ্যালেঞ্জ ছুড়েই ধারেও কাটেন আবার ভারেও ।
আরও পড়ুন: