হায়দরাবাদ, 9 মার্চ: দিনে দিনে পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থান ও উত্তরাখণ্ড-সহ সারা দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বাড়ছে পশু-মানুষের সংঘাতের ঘটনা ৷ এর ফলে প্রাণহানির বহু ঘটনা ঘটছে ৷ বিশেষত বাঘ, হাতি এবং চিতাবাঘের আক্রমণে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি দেশে ৷ এক নজরে দেখে নেওয়া যাক মানুষ-পশুর সংঘাতে দেশের নানা রাজ্যের চিত্রটি ৷
মানুষ-বন্যপ্রাণীর সংঘাত
মানুষ জীবিকার খোঁজে বনে পশুদের বাসস্থানে ঢুকে পড়ে ৷ আবার বন্যপ্রাণীরা খাবারের খোঁজে লোকালয়ে চলে আসে ৷ এর ফলে মানুষ ও পশুদের মধ্যে সংঘাত দেখা যায় ৷ তাতে মানুষ এবং বন্যপ্রাণী উভয়েরই ক্ষতি হয় । অনেক সময় পশুদের হাতে মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে ৷ আবার উলটোটাও হয় ৷ লোকালয়ে চলে এলে পশুর উপর আঘাত হানা হয় ৷
এই পরিস্থিতি সারা দেশে মানুষ-বন্যপ্রাণীর সংঘাত মোকাবিলায় নীতি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয় ৷ মানুষ-পশুর সংঘাতকে বিস্তৃতভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে ৷ যেমন, মানুষ-বাঘের সংঘাত, মানুষ-চিতাবাঘের সংঘাত এবং মানুষ-হাতির সংঘাত ।
দেশে সবচেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের পশুর আক্রমণে মানুষের মৃত্যু হয় ৷ বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ দ্বীপ সুন্দরবন ৷ এখানে 500টিরও বেশি রয়াল বেঙ্গল টাইগারের বাসস্থান ৷ তবে রয়াল বেঙ্গল টাইগারের আক্রমণে প্রতি বছর 50 থেকে 100 জনের মৃত্যু হয় সুন্দরবনে ।
ভারতে মানব-হাতির সংঘর্ষে বছরে 400 জনের প্রাণহানি ঘটে । সংরক্ষণের দিকগুলি দেখাশোনাকারী সংস্থাদের রিপোর্ট অনুসারে এই ঘটনাগুলিতে বেশিরভাগই আর্থ-সামাজিক দিক থেকে দুর্বলদের উপর হামলা হয়েছে ৷
অনুমান অনুযায়ী, চিতাবাঘ অন্যান্য সব মাংসাশী প্রাণীর তুলনায় ভারতে বেশি মানুষকে হত্যা করে ৷ আর মানুষ ও চিতাবাঘের সংঘর্ষের খবর বেশিরভাগই পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র এবং অসম থেকে পাওয়া যায় । উল্লেখযোগ্যভাবে মানব-খাদক চিতাবাঘের জন্য বিখ্যাত উত্তরাখণ্ডের করবেট ন্যাশনাল পার্ক ৷ এখানে মানুষের উপর ঘন ঘন চিতাবাঘের আক্রমণের ঘটনা ঘটে ।
পাহাড়ে মানুষ-পশুর সংঘাত
গত তিন বছরে পশুর হামলায় উত্তরাখণ্ড থেকে 219 জন মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে । একই সময়ে রাজ্যে এই ধরনের হামলায় 1 হাজার 3জন মানুষের আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে । 2021 সালে উত্তরাখণ্ডে 71 জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে । পরের বছর এই সংখ্যা বেড়ে 82-এ দাঁড়ায় ৷ যদিও 2023 সালে সংখ্যা কমে গিয়েছিল ৷ সে বছর পশুর আক্রমণে 66 জনের মৃত্যু হয়েছিল ।
উত্তরাখণ্ডে 2021 সালে চিতাবাঘের আক্রমণে 23 জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ৷ তারপরে 2022 এবং 2023 সালে যথাক্রমে 22 এবং 18 জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে । রাজ্যে 2021 সালে হাতির আক্রমণে 13 জন মানুষের প্রাণহানির হয়েছে । 2022 সালে পরিসংখ্যানটি ছিল 9 এবং পরের বছর হাতির সঙ্গে সংঘর্ষে আরও পাঁচজন প্রাণ হারায় । রাজ্যে চিতাবাঘের আক্রমণে মৃত্যুর হার বেশি।
উত্তরাখণ্ড গত তিন বছরে বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর ঘটনা কম ঘটেছে । তবে সংখ্যাটি 2021 সালে 2 ছিল ৷ পরে প্রায় দশগুণ বৃদ্ধি পেয়ে 2023 সালে 17 হয়েছে । 2022 সালে রাজ্যে বাঘের আক্রমণে 16 জনের মৃত্যু হয় ।
এলিফ্যান্ট করিডোরে মানুষ-প্রাণীর সংঘাত
পশ্চিমবঙ্গ হল আরেকটি রাজ্য যেখানে প্রায়শই মানুষ-প্রাণী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে । রাজ্যের উত্তর ও পশ্চিম অংশে এলিফ্যান্ট করিডোর বেশি রয়েছে ৷ তাই এমন অঞ্চলে এই ধরনের ঘটনা সাধারণত বেশি ঘটে থাকে ।
2008 সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় 450টি হাতি ছিল । 2010 সালে সংখ্যাটি 530টিতে গিয়ে দাঁড়ায় এবং 2014 সালে সংখ্যাটি বেঁড়ে 640 হয়ে যায় ৷ রাজ্যের উত্তরবঙ্গে বর্তমানে হাতির সংখ্যা প্রায় 700 ৷ তবে এই হাতির সংখ্যা বৃদ্ধি বন বনদফতরকে সমস্যায় ফেলেছে ৷ কারণ রাজ্যে হাতির সংখ্যা বাড়লেও সেই তুলনায় বনাঞ্চল অনেক কম ৷ তঙ্গল বাড়াল বদলে বরং দিন দিন কমে যাচ্ছে । বন বিভাগের কাছে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে, হাতির আক্রমণে প্রতি বছর গড়ে প্রায় 35 থেকে 50 জন মানুষের মৃত্যু হয় বাংলায় ।
জঙ্গলমহলে মানুষ-পশুর সংঘাত
ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা নিয়ে গঠিত বাংলার জঙ্গলমহল এলাকা ৷ এখানে ঘন ঘন হাতির আক্রমণের শিকার হয় মানুষজন । প্রতিবেশী ঝাড়খণ্ড রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত হাতির করিডোরের কারণে এই এলাকাগুলিতেও গ্রাম এবং কৃষি জমিতে হাতির প্রবেশের ঘটনা ঘটে ৷ এই পরিস্থিতি মানুষের জীবনে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ । ঝাড়গ্রামের ডিএফও পঙ্কজ সূর্যবংশী ইটিভি ভারতকে বলেছেন, "মানুষ বন্য হাতির সংস্পর্শে আসার কারণে 1 এপ্রিল 2023 সাল থেকে আমরা এই বছর পর্যন্ত 17 জন মানুষের হতাহতের ঘটনা রেকর্ড করেছি ।"
বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ অঞ্চল সুন্দরবন রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের জন্যও পরিচিত । ঘন অরণ্য, একের পর এক ঘূর্ণিঝড়, ব্যাপক ক্ষয় এবং মানুষের বাসস্থানের দিন দিন বিস্তার ইতিমধ্যেই সুন্দরবনের ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে । এলাকার মানুষেরা প্রতিনিয়ত বনের গভীরে মধু সংগ্রহ করতে ঢুকে পড়ে । এছাড়াও স্থানীয়রা কাঁকড়া ও মাছ ধরার জন্য সুন্দরবনের নদী এবং খালগুলি অতিক্রম করে জঙ্গলের গভীরে বাঘের ডেরার চলে যায় ৷ এর ফলে তারা বাঘের হামলার শিকার হয় । বন কর্মকর্তাদের মতে, সুন্দরবনে সরাসরি বাঘের সংস্পর্শে আসার পর গত পাঁচ বছরে 13 জনের প্রাণহানি ঘটেছে ৷
আরও পড়ুন: