ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি রয়েছে হিমালয়বর্তী রাজ্যগুলিতে

author img

By

Published : Feb 14, 2021, 8:33 PM IST

হিমালয়ের পার্বত্য এলাকার ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি

হিমালয়ের হিমবাহগুলি থেকে বরফ ভেঙে যাওয়ার ঘটনা 21 শতকে দ্বিগুণ হয়েছে ৷ ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি রয়েছে হিমালয়বর্তী রাজ্যগুলিতে ৷ প্রতিবেদনটি লিখেছেন ইটিভি ভারতের নিউজ় কো-অর্ডিনেটর কে প্রবীণ কুমার ৷

জে এম মুরার, জে এম শ্যাফার, এস রুপার এবং এ কার্লির নামে কয়েকজন গবেষক হিমালয়ের হিমবাহগুলি নিয়ে গবেষণা করেন । তাতে দেখা গিয়েছে যে 2000 সাল থেকে 2016 সালের এই সময়কালে হিমালয়ের হিমবাহগুলি থেকে বরফ ভাঙার ঘটনা দ্বিগুণ হয়েছে । এই গবেষকরা এসেছিলেন লামন্ট-ডোহার্টি আর্থ অবজারভেটরি ও আর্থ অ্যান্ড এনভায়রেনমেন্টাল সায়েন্স থেকে । উভয়ই কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের সঙ্গে যুক্ত । এই গবেষকরা 1975 সাল থেকে 2000 সাল এবং 2000 সাল থেকে 2016 সালের মধ্যে বরফ ভাঙার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেন । তাঁদের অনুসন্ধান হিমালয় ও উপ-হিমালয় এলাকার জন্য একটি সতর্কবার্তা তৈরি করেছিল । গবেষণায় এর জন্য একাধিক কারণ উঠে এসেছিল । সেগুলি হল - বায়ুমণ্ডলীয় উষ্ণায়নের মতো পরিবেশগত ভাবে ধ্বংসাত্মক ঘটনা, তুষার এবং বরফের উপর অ্যানথ্রোপোজেনিক ব্ল্যাক কার্বন জমা হওয়া এবং অবিরাম বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনের কারণে আলবেডো প্রভাব ।

এই গবেষণাটি নিখুঁতভাবে পরিবেশগত কারণগুলির ভিত্তিতে করা হয়েছিল । এই কারণগুলির ফলে বরফ ভাঙার পরিমাণ বৃদ্ধি করে । অন্যান্য বহু গবেষণায় দূষণের অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক উৎসগুলির প্রভাবকে সমন্বিত করে, হিমালয় পর্বতের অপরিকল্পিত উন্নয়ন এবং পর্যটন সম্পর্কিত উন্নয়নমূলক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করেছিল যে ভয়ঙ্কর কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে । ঠিক যেমন সম্প্রতি উত্তরাখণ্ডে ঘটেছে ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে অমরনাথ যাত্রা, বদ্রীনাথ এবং কেদারনাথ যাত্রা, কৈলাস মানসারোবর যাত্রা এবং চারধাম যাত্রার মতো ধর্মীয় পর্যটনে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ এই পার্বত্য অঞ্চলে যান । পর্যটন সংক্রান্ত পরিকাঠামো এই পর্যটকদের কোনও রকম কঠোর বিধিনিষেধ ছাড়াই উপরে উঠতে সাহায্য করে । অনিয়ন্ত্রিত মোটর চালিত যানবাহন চলাচল এলাকার দূষণকে বাড়িয়ে তোলে এবং এই ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রে মানুষের দ্বারা তৈরি হওয়া দূষণও একটা ভূমিকা পালন করে । যখন অর্থনৈতিক কারণের জন্য উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, তখন বনভূমি নিধন অবধারিত ভাবে শুরু হয়ে যায় । পর্যটনের সুবিধার জন্য এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য হিমালয়ের রাজ্যগুলিতে বেশ কয়েক বর্গ কিলোমিটার স্থায়ী বন পরিষ্কার করা হয়েছে । এই বনগুলিতে কার্বন প্রাকৃতিক ভাবে জমা হত এবং বন কেটে ফেলার জন্য এই ব্ল্যাক কার্বন হিমবাহের বরফে জমা হওয়া শুরু হয়েছে ।

অস্থির প্রোগ্লেসিয়াল হ্রদ সম্প্রসারণের ফলে বরফ ভাঙার ঘটনা বেড়ে যেতে থাকায় বন্যার ঝুঁকি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে । উত্তরাখণ্ডের ভয়ঙ্কর ঘটনার পিছনে এটাই অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে । বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন যখন পরিবেশগত ভাবে ভঙ্গুর অঞ্চলগুলির ক্ষতি করছে, তখন মানুষের দ্বারা অবৈজ্ঞানিক উন্নয়নের কাজ বিষয়টিকে আরও ধ্বংসাত্মক করে তুলছে । গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে হিমালয়ের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা 1945 সাল থেকে 2000 সালের তুলনায় 2000 সাল থেকে 2016 সালের মধ্যে 0.4 ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে 1.4 ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়েছে । এই উষ্ণতর তাপমাত্রার জন্যই তুষার আরও দ্রুত পাতলা হয়ে যাচ্ছে ।

এখানে দেশকে এগিয়ে আসতে হবে পরিবেশগত ভাবে ভঙ্গুর হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল (এইচএমএ) - কে রক্ষা করার জন্য । আর এই নিয়ে একটি পরিকল্পনাও তৈরি করতে হবে । কারণ, এই অঞ্চল হিমালয় ও উপ-হিমালয় এলাকার জীবন ও জলবায়ুর বৃহত্তম প্রাকৃতিক সম্পদ । সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের হাইড্রোলজি হিমালয়ের হিমবাহের স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করে । যদিও ভারত সরকার একটি সুরক্ষিত হিমালয় প্রকল্প চালু করেছে, তবুও এই অঞ্চলের মানুষের জীবন এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বাস্তবতার ভিত্তিতে টেকসই বিকাশকে রক্ষা করার জন্য খুবই কম কাজ করা হয়েছে ।

এতে কোনও রকম সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করতে হবে এবং যত্ন নিতে হবে । একটি টেকসই পর্যটন যা পরিবেশ বান্ধব হবে, কৃষি হবে জৈব পদ্ধতিতে, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পুনর্নবীকরণ এবং বন বৃদ্ধির প্রকল্পই একমাত্র পথ যার মাধ্যমে এই সংবেদনশীল অঞ্চলটিকে সুরক্ষিত করা যায় । আর স্থানীয়দের কাছে মূল উপকারক হিসাবে সম্পদের মনিটাইজেশনের বিষয়টির যত্ন নিতে হবে ।

উন্নয়নের নামে ব্যাপক বনাঞ্চল ধ্বংস করার ফলে এই অঞ্চলে ভূমিধস এবং বন্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে । উত্তরাখণ্ডের সরকার একাই সেখানে গঙ্গার অববাহিকায় 100 মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে এমন প্রায় 70টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন করেছে । এইচএমএ -র আশপাশের বেশ কয়েকটি রাজ্যও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বন বৃদ্ধি বা উপলব্ধ জন্য বাঁধগুলির পুনঃব্যবস্থাপনের পরিকল্পনা ছাড়াই এই জাতীয় বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে আসছে । জানা গিয়েছে যে এখনকার অনেক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির বেশিরভাগই খারাপ ভাবে নির্মিত হয়েছে এবং এই অঞ্চলের হাইড্রোলজিতে আরও বেশি প্রভাব ফেলেছে । এর ফলে এই অঞ্চলে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ।

গ্রিন হাউজ় গ্যাস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করাও এইচএমএ - র জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ করার পথে আরও একটি বড় পদক্ষেপ । হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল অ্যানথ্রোপোজেনিক ব্ল্যাক কার্বন নিঃসরণের অন্যতম জায়গা হয়ে গিয়েছে । হিমালয়ের সমস্ত রাজ্যেগুলিকে জৈব কৃষিকাজ এবং পর্যটনের বিকাশে প্রকৃতি বান্ধব ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত । যদিও মেঘালয় নিজেদের প্রথমে জৈব রাজ্য হিসাবে ঘোষণা করেছিল, তবে অন্যান্য রাজ্যগুলিতে বর্তমান থাকা একাধিক বন আইন সম্পূর্ণ জৈবিক হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে । এই অস্থিতিশীল হিমালয় অঞ্চলের কৃষকরা কঠোর বন আইনের কারণে তাঁদের জৈব ফসলের দাবি করতে পারছেন না । টেকসই জৈব চাষ করার পদক্ষেপ এই এলাকাগুলির স্থিতিশীলতা আরও বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে এবং বনাঞ্চলের উপর চাপ কমাবে । যার উপর মানুষ আয়ের জন্য নির্ভরশীল ।

যখন দীর্ঘমেয়াদী পর্যটন ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে, তখন থেকেই পৃথিবীর পরিষ্কার জল পাওয়ার উৎস প্লাস্টিকের বর্জ্য দ্বারা দূষিত হতে শুরু করেছে । এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবৈজ্ঞানিক, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কাজ । বন্যার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলিতে লজ এবং হোটেলগুলি তৈরি করা হচ্ছে । নির্মাণ কাজ ইতিমধ্যে ওই অস্থির এলাকাগুলিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলেছে । আর তার ফলেই ক্রমশ তুষার ধস ও বন্যা হচ্ছে ।

হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের নগরায়ণের বিভিন্ন শারীরিক এবং আর্থ-সামাজিক চালক রয়েছে । কিছু গবেষণায় হিন্দু কুশ হিমালয় অঞ্চলে ব্যাপক নগরায়নের বিষয়টি নথিভুক্ত হয়েছে । এই অঞ্চলের মধ্যেই পড়ছে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তান । অনেক অঞ্চলে নৈনিতালের মতো বড় শহরগুলি তৈরি হয়েছে এবং সংবেদনশীল পার্বত্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে । যদিও ২০০২ সালে জোহানেসবার্গে সাস্টেনেবল কনফারেন্সে এই সংবেদনশীল বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়েছিল, তবে এই অঞ্চলে ব্যাপক হারে নগরায়নের তদারকি করার জন্য খুব সামান্য কাজ করা হয়েছে ।

আরও পড়ুন : আইনি জটিলতা এড়াতে আলাদা থাকার পথ বেছে নিচ্ছেন দম্পতিরা

পরিবেশ বান্ধব মনিটাইজিং কার্যক্রম নিশ্চিত করার পরে যদি এইচএমএ রক্ষা করার জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হয়, তবে হিমালয়ের অনেক রাজ্যই চরম প্রাকৃতিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে রয়েছে । অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার অমিতাভ পান্ডে, যিনি উত্তরাখণ্ডে কাজ করার সূত্রে ওই অঞ্চল সম্পর্কে অভিজ্ঞ, তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন যে 2013 সালে উত্তরাখণ্ডে ট্র্যাজেডি ঘটার পর, তিনি হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল রক্ষা করার জন্য তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ করার কথা বলে একটি নোট দিয়েছিলেন । কিন্তু মনমোহন সিং ও মোদি সরকার, উভয়েই এড়িয়ে গিয়েছে । জলবায়ু পরিবর্তনের দ্রুত প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণে রাশ টানা প্রতিটি দেশের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে । এবং এইচএমএ - র আরও ভালো সুরক্ষার জন্য ভারতকে তার বর্তমান নিয়মকে ভালো করে মূল্যায়ন করতে হবে ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.