ফসল বিমাকে কৃষকদের জন্য লাভদায়ক করে গড়ে তুলতে হবে : পিএমএফবিওয়াই নিয়ে একটি বিশ্লেষণ

author img

By

Published : Dec 19, 2020, 5:08 PM IST

PMFBY

ফসল উৎপাদনের ক্ষতির কথা মাথায় রেখে 2016 সালে প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা শুরু হয়েছিল । এই বিমা যোজনার মধ্যে জলবায়ুর কারণে ফসলের ক্ষতি, কীট থেকে ক্ষতি এবং ফসল ফলনের পরবর্তী ক্ষতি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে । এই যোজনা কৃষকদের জন্য লাভদায়ক করে তুলতে হবে । আলোচনায় মিজোরাম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের প্রধান ড. এন ভি আর জ্যোতি কুমার ।

2016 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সূচনা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা (পিএমএফবিওয়াই)-র । এটা পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ফসল বিমা যোজনা । ফসল উৎপাদনের ক্ষতির কথা মাথায় রেখেই ভারতীয় কৃষকদের জন্য এই বিমার সূচনা করা হয়েছিল । এই যোজনা খুবই উচ্চ পরিমাণের ভর্তুকিযুক্ত এবং আর এই ক্ষেত্রে কৃষকদের তরফে খুব কম পরিমাণে কিস্তি দিতে হয় । এই যোজনার অধীনে খাদ্যশস্য ও তৈলবীজ সংক্রান্ত ফসলের জন্য কৃষকদের খরিফ মরসুমে 2 শতাংশ ও রবি মরসুমে 1.5 শতাংশ কিস্তি দিতে হয় । বার্ষিক বাণিজ্যিক ফসলের জন্য কৃষককে সর্বাধিক 5 শতাংশ কিস্তি দিতে হয় । সঠিক কিস্তি ও কৃষকদের তরফে দেওয়া কিস্তির মধ্যে যে ফারাক থেকে যায়, সেই টাকা সমানভাগে ভাগ করে দেয় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি । মরসুমি ফসলের জন্য ঋণ নেওয়া সমস্ত কৃষকদের পিএমএফবিওয়াই যোজনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । অন্য কৃষকরা নিজে থেকে ওই বিমা কিনতে পারেন । তাঁদেরও একই হারে কিস্তি দিতে হয় । বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি এই ধরনের যোজনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । তার মধ্যে রয়েছে – জলবায়ুর কারণে ফসলের ক্ষতি, কীট থেকে ক্ষতি এবং ফসল ফলনের পরবর্তী ক্ষতি । গুরুত্বপূর্ণ ফসলের জন্য গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে সাধারণ এই বিমার একক কার্যকর করা হয় ‘এলাকা ভিত্তিক’ হিসেবে ।

কার্যকরী প্রয়োগ নিয়ে রাজ্যগুলি ধন্দে রয়েছে

2017-18 আর্থিক বছরে খরিফ ও রবি উভয় মরসুমেই পাঁচ কোটির বেশি কৃষক এই যোজনার অধীনে নাম লিখিয়েছিল । 2015 সালে যখন পূর্ববর্তী বিমা যোজনা জারি ছিল, সেই সময়ের থেকে এটা 40 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে । তবে সাম্প্রতিক কিছু রিপোর্টে বিভিন্ন রাজ্যে পিএমএফবিওয়াই প্রকল্প রূপায়ন ঘিরে সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে । তার কারণ, কয়েকটি রাজ্য এই প্রকল্প থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করেছে । বিহার ও গুজরাত ইতিমধ্যেই এই প্রকল্প থেকে বেরিয়ে গিয়েছে । গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানী জানান , বিমা সংস্থাগুলি প্রচুর পরিমাণে কিস্তি (4500 কোটি টাকা) দাবি করায় গুজরাত সরকার এই যোজনা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে । কেন্দ্রীয় যোজনার বদলে বিকল্প হিসেবে গুজরাত সরকার মুখ্যমন্ত্রী কিষাণ সহায় যোজনা শুরু করেছে । যার অর্থ দিচ্ছে রাজ্য সরকারই । 2020 সালের খরিফ মরসুমে সমস্ত কৃষক কোনও কিস্তি না দিয়েই এই প্রকল্পের অধীনে আসতে পারছেন । এর জন্য 1700 থেকে 1800 কোটি টাকা খরচ হচ্ছে । বাংলা ও বিহার সরকারেরও নিজস্ব ফসল বিমা যোজনা রয়েছে । আর এর জন্য কৃষকদের কোনও কিস্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না । পঞ্জাব কোনওদিনই পিএমএফবিওয়াই কার্যকর করেনি । সংবাদে কিছু প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে যে এই যোজনা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এই বছরের (2020) গোড়ার দিকে আরও কয়েকটি রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি লিখেছে । কৃষকরা কোনও কিছুর দাবি জানাতে না পারায় অধিকাংশ রাজ্যই তাদের অংশের কিস্তি দিতে দেরি করছে ।

খবরে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, 2019 সালের খরিফ মরসুমে ফসল বিমার আওতায় কৃষকরা যে অর্থ দাবি করেছিলেন বিমা সংস্থাগুলি তার এক তৃতীয়াংশও দেয়নি । কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রকল্প থেকে কৃষকদের তুলনায় কিছু বিমা সংস্থা বেশি লাভ করছে বলে এর থেকে ধারণা তৈরি হয়েছে । এরপর বেশ কয়েকটি সাম্প্রতিক ইশু নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে । তার মধ্যে রয়েছে - নিভার ঘূর্ণিঝড়ের প্রেক্ষিতে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার ঝুঁকির ক্ষেত্রে এই বিমার কিস্তি দিতে অস্বীকার করেছে । এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতীয় রাজধানীতে কৃষক সংগঠনগুলির ডাকা বিক্ষোভের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি পাচ্ছে । এর সঙ্গেই কার্যকরী ফসল বিমা নিয়ে ব্যবসায়িক মডেল তৈরির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে । আর এটা করতে হবে কৃষিক্ষেত্রের জন্য । যা গ্রামীণ ভারতের 70 শতাংশ পরিবারের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় অবলম্বন ।

চ্যালেঞ্জকে কীভাবে মোকাবিলা করা হবে ?

আইআইএম আহমেদাবাদ একটি সমীক্ষা করে । যে সমীক্ষার পৃষ্ঠপোষক ছিল ভারত সরকারের কৃষি ও কৃষক কল্যাণমন্ত্রক । দেশের নয়টি রাজ্যে পিএমএফবিওয়াই-এর কার্যকারিতা নিয়ে সমীক্ষা করা হয় । তাতে উঠে এসেছে যে, কৃষকরা এই যোজনা সম্পর্কে একেবারেই অবগত নন । ঋণ নিয়ে যাঁরা চাষ করেছেন । আর ঋণের টাকা থেকে যাঁরা বিমার কিস্তি দিয়েছেন, তাঁরাও ভালোভাবে এই যোজনা সম্বন্ধে জানেন না । বাংলায় এই যোজনা সম্বন্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল পঞ্চায়েতগুলি । অন্যদিকে, অসমে এই যোজনাকে সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ব্যাঙ্কগুলির । আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল অধিকাংশ রাজ্যেই বিমা এজেন্টদের ভূমিকা সেই অর্থে ছিল না । এই বিষয়টির উপর আলাদা করে নজর দেওয়া উচিত । কারণ, যে সমস্ত কৃষকরা নিজেদের ইচ্ছায় বিমা নেন, তাঁদের মধ্যে অনেক সময় ঋণ না নেওয়া কৃষকরাও থাকেন । তাঁদের প্রত্যেককেই বিমা করানোর সময় বিমা সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট এজেন্টদের উপরই ভরসা করে থাকতে হয় । এই সমীক্ষায় কৃষকরা বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন । সেগুলি হল, বিমা করানোর জন্য নথিপত্র তৈরিতে যে সময় লাগে, তা কমিয়ে আনা । ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বৃদ্ধি করা, যোজনায় আরও স্বচ্ছতা নিয়ে আসা, সচেতনতা বৃদ্ধি করতে আরও প্রচেষ্টা, গৃহপালিত প্রাণীর মৃত্যুকে বিমার আওতায় আনা আর এই নিয়ে পঞ্চায়েতের ভূমিকা বৃদ্ধি করা । সমীক্ষা অনুযায়ী, কৃষকরা পিএমএফবিওয়াই-এর মতো একটি পলিসিতে কৃষকরা 10 শতাংশ পর্যন্ত কিস্তি দিতে রাজি আছেন । বর্তমান হারের চেয়েও বেশি হারে, তাঁরা তা দিতে রাজি । কিন্তু তাঁদের দাবি, ক্ষতির পর্যালোচনা হওয়ার ছয় সপ্তাহের মধ্যে টাকা দিয়ে দিতে হবে । আর এটা বুঝিয়ে দিচ্ছে ফসল বিমার চাহিদা কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে ঠিক কতটা পরিমাণে রয়েছে ।

অন্যদিকে, বিমা সংস্থাগুলি ফসল বিমাকে লাভজনক বলে মনে করছে না । তাদের কাছে এর মধ্যে ‘ভালো ঝুঁকি’-র চেয়ে ‘খারাপ ঝুঁকি’ বেশি রয়েছে । এই ধরনের নেতিবাচক চিন্তা ভাবনাই সকলের মধ্যে এই ধারণা গড়ে তুলল যে ব্যবসায়িক ভাবে এই মডেল দীর্ঘস্থায়ী নয় । এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে রাজ্য সরকারগুলির ভাবনা । তারা ভর্তুকি হিসেবে কিস্তির পঞ্চাশ শতাংশ দেয় । আর কৃষকরা ক্ষতি হলেই তবে টাকা পান । সেই কারণে রাজ্য সরকারগুলি মনে করে যে বিমা সংস্থাকে টাকা দেওয়া অপচয় । অথচ বিমা ব্যবসায় এটাই নিয়ম । এর সঙ্গে দেরিতে বিমা সংস্থার কাছ থেকে টাকা পাওয়াও কৃষকদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে । ফসলের ক্ষতির সঠিক পর্যালোচনা করাও বিমার ক্ষেত্রে বাস্তবিক চ্যালেঞ্জ । এটাকে বলা হয় কর্প কাটিং এক্সপেরিমেন্টস (সিসইএস) । দীর্ঘমেয়াদী ব্যবসায়িক সুযোগের সুবিধা অর্জন করতে হলে বিমা সংস্থাগুলিকে স্থানীয় স্তরে উপযুক্ত পরিকাঠামো সহ কার্যালয় গড়ে তুলতে হবে । স্মার্ট ফোন, রিমোট সেন্সিংয়ের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের ক্ষতির পর্যালোচনা করার রিপোর্ট সংগ্রহ করা যায় ও আপলোড করা যেতে পারে । তাতে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সময়ও অনেকটা কমে ।

আরও পড়ুন , দক্ষ শ্রমিকরাই পারে দেশের উন্নয়নকে মজবুত করতে

সার্বিকভাবে এটা বলা যায় যে, পিএমএফবিআই-কে আরও সুগঠিত এবং রাজ্য, কৃষক ও বিমা সংস্থাগুলির কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে । কর্পোরেটের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিকে এক সঙ্গে কাজ করা উচিত । আর এই যোজনার কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে জেলা ও গ্রাম স্তরের প্রতিনিধিদের আরও কাজে লাগানো উচিত । পিএমএফবিওয়াই যদি গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে দু’টি তেলুগু রাজ্যের কৃষকদের জন্য আরও সুগঠিত, বিস্তারিত ও লাভজনক পলিসির প্রয়োজন রয়েছে । কারণ, এখানে আবহাওয়া গতিপ্রকৃতি প্রায়ই বদল হয়, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে প্রায়ই ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে, বৃষ্টিপাতও ঠিক মতো হয় না । তার জন্য এখানে ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেশি । যদিও পিএমএফবিওয়াই ভালো উদ্দেশ্য তৈরি হওয়া একটি যোজনা, এটাকে আরও কার্যকরীভাবে বাস্তবায়িত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে । কারণ, আগামী বছরগুলিতে যাতে কৃষকরা আরও ঝুঁকির মুখে না পড়ে আর আরও গরিব যাতে না হয়ে যায় । আর ভারতে কিন্তু এটা একেবারেই কোনও ছোটো চ্যালেঞ্জ নয়। কারণ, এটা ক্রমশ অসুরক্ষিত হয়ে যাচ্ছে ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.