‘সততার স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটা ব্যবস্থা অনৈতিক শক্তিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে’ – তাদের রিপোর্টে একথাই বলেছিল দ্বিতীয় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন (এআরসি)। দশকের পর দশক ধরে ভারতের আমলাতন্ত্র দাঁড়িয়ে রয়েছে চারটি স্তম্ভের ওপর – দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, জনগণকে লুঠ করা এবং নিরবচ্ছিন্ন গোপনীয়তার ট্রেন্ড। এতে সমস্ত স্তরের গভীরে শিকড় বসানো দুর্নীতিই প্রশ্রয় পাচ্ছে। যদিও 1964 সালে কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশন (সিভিসি) তৈরি হয়েছিল, যাতে প্রশাসনিক স্তরবিন্যাসের মধ্যে প্রতারণা ও দুর্নীতির ওপর নজর রাখা যায়, এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে কাগুজে বাঘ। সিভিসি সম্প্রতি কেন্দ্র সরকার, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চিফ এক্সিকিউটিভ এবং বিমা কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে, যাতে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা দুর্নীতির মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হয় আগামী মে মাসের মধ্যেই। কিন্তু আসল ব্যাপার হল, প্রশাসনের যে কর্তাব্যক্তিরা তাঁদের ঘনিষ্ঠদের আড়াল করতে দক্ষ, তাঁরা এইসব নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখাতে ভালই জানেন।
এই ব্যবস্থা দুর্নীতিতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, যে কোনও নথি এক জায়গা থেকে অন্যত্র যাওয়ার প্রতিটা স্তরে ঘুষ দেওয়া আবশ্যক। প্রশাসনের উঁচু মহল এসব ভালই জানে, কিন্তু তারা অন্ধ সেজে থাকে, এমনকী দুর্নীতিগ্রস্ত আধিকারিককে সমর্থনও করে। সিভিসি স্পষ্ট করে দিয়েছে, যে তদন্তে দেরি হলে তা দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীকেই উৎসাহিত করবে এবং তার জেরে মামলায় যুক্ত সৎ মানুষদের মহা দুর্ভোগে পড়তে হবে। বিভিন্ন স্তরে কীভাবে তদন্ত করতে হবে, তার স্পষ্ট গাইডলাইন থাকলেওকেউ গ্রাহ্য করে না। 2011 থেকে 2018 সালের মধ্যে হওয়া মামলাগুলো এখনও একই জায়গার ঝুলে রয়েছে। সিভিসির মতে, দুর্নীতির মামলাগুলো স্তুপীকৃত হচ্ছে, তার কারণ হয় আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছে, অথবা আদালতে মামলা বিচারাধীন, অন্য কেসে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় অভিযুক্তকে বরখাস্ত করা হয়েছে, অথবা কেন্দ্রের ডিউটি করার সময় বেনিয়ম করা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোর তরফে কোনও তথ্য মিলছে না। 2018 সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, যে দুর্নীতির মামলায় আদালতের স্থগিতাদেশের সময়সীমা ছ’মাসের বেশি হবে না। এই রায়কে তুলে ধরে সিভিসি চাইছে মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি হোক, কিন্তু তাতে কেউ কান দিচ্ছে না। সেই আমলাতন্ত্রকে ধন্যবাদ যারা এশিয়ার সবথেকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে ভারতের বদনামকে অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতারণা রুখতে ভিজিল্যান্সের ব্যর্থতা
মোদি যেভাবে ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’র সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি ও অদক্ষতাকে দূর করতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করছেন, তা শুধু মুদ্রার একটা পিঠ। উল্টো পিঠের কঠোর বাস্তব হল, কেন্দ্রীয় মন্ত্রক ও দফতরগুলোর দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসারদের বাঁচিয়ে চলা। 2018 সালে 44টি মামলায় সিভিসির সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেছে বিভিন্ন মন্ত্রক। এদের মধ্যে রেলেরই রয়েছে 19 টি মামলা। সিভিসির সুপারিশ অনুযায়ী, রেলে টেন্ডার দুর্নীতির তদন্ত করেছিল সিবিআই। 2013 সালে তিনটি বেসরকারি সংস্থা ও 11 জন রেল আধিকারিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়, এবং একজন মূল অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণের সুপারিশ করা হয়। যখন সিভিসি 2018 সালে একজন দুর্নীতিগ্রস্ত আধিকারিককে বিপুল অঙ্কের জরিমানা করার পরামর্শ দেয়, তখন রেলমন্ত্রক বলে দেয় যে তাঁর নাকি কোনও দোষই ছিল না। যখন সিভিসি তদন্তে দেখা যায় যে পরমাণু শক্তি দফতরে দুর্নীতির কারণে ইউরেনিয়াম কর্পোরেশনের 46 কোটি টাকা ক্ষতি হয়, তখন দফতর সামান্য হুঁশিয়ারি দিয়েই কাজ সেরেছিল। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ হায়দ্রাবাদে 48.53 কোটি টাকা ঋণ বকেয়ার মামলায়, ব্যাঙ্ক সিবিআইয়ের কাছে অভিযোগ জানালেও, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি দেয়নি কর্তৃপক্ষ। দুর্নীতির আগাছা জন্মাবার সবথেকে উপযুক্ত জমি, ভারতের থেকে ভাল আর কিছু হতে পারে কি? দেশের অগ্রগতি ব্যাহত করছে এমন এক পরিবেশ, যেখানে তদন্তকারী সংস্থাগুলোর ডানা ছাঁটা হচ্ছে, তাদের শেকল বেঁধে রাখা হচ্ছে, আর এর জেরে দুর্নীতিগ্রস্ত অপরাধীরা যা খুশি করে বেড়াতে পারছে।
আরও পড়ুন : UPA সরকার সরাতে AAP-কে সমর্থন করেছিল RSS-BJP : রাহুল
সিভিসিকে সংসদে বার্ষিক রিপোর্ট জমা দিতে হয়, যার মধ্যে থাকে তদন্তকারী সংস্থার সুপারিশের প্রেক্ষিতে সরকারি দফতরগুলোর জবাবের বিবরণও। তিন মাসে জমা পড়া সেই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, 2019 সালে 54টি মামলায় সুপারিশ মানাই হয়নি। সিভিসির আক্ষেপ, এই প্রবণতা তদন্তকারী সংস্থার নিরপেক্ষতাকেই নস্যাৎ করে দিচ্ছে। যে 678 টি মামলায় তদন্ত চলছে, তার মধ্যে 25টি পাঁচ বছরেরও বেশি এবং 86টি তিন বছরের পুরনো। সিভিসির মতে, এর থেকেই স্পষ্ট হচ্ছে যে আমাদের তদন্তব্যবস্থা কতটা অসাড়। তদন্তাধীন 6226 টি দুর্নীতি মামলার মধ্যে 182 টি ঝুলে রয়েছে 20 বছর ধরে এবং 1599 টি ঝুলে রয়েছে দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। সর্বত্রগামী দুর্নীতিই বাস্তব আর তদন্তের অনুমতি দেওয়া সন্দেহজনক। যে ব্যবস্থায় শাস্তিই হয়না, সেখানে তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকা তলানিতে এসে ঠেকেছে। যদি না তাদের শক্তিশালী করে সরাসরি সংসদের কাছে দায়বদ্ধ করা না যায়, তাহলে দুর্নীতি নির্মূল করার প্রয়াসটা হবে কুকুরের লেজ ধরে গোদাবরী নদী পেরোবার মতোই।